ঘসেটি বেগম: দুর্বিনীত ও উচ্চাভিলাষী এক নারী

শুনলাম ঘসেটি বেগমের জীবনীকে এবার বড় পর্দায় নিয়ে আসছেন কলকাতার নির্মাতা অর্জুন দত্ত। সত্যাসত্য জানি না। তবে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এই বায়োপিক নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। শুধু তাই নয় ঘসেটি বেগমের চরিত্রের জন্য বিগ বাজেটের দুজন নায়িকার নামও উঠে এসেছে। একজন হলেন স্বস্তিকা মুখার্জি আর অন্যজন জয়া আহসান, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী পাওলি দামের নামও উঠে এসেছে। 

ইতিহাস বলে ঘসেটি বেগম নামটার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমাটা বেশ ভালোভাবেই জুড়ে গেছে। কারণটা নতুন করে বলার কিছু নেই। সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা ছিলেন তিনি। ছিলেন কি ছিলেন না এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক এখনো বিদ্যমান। তো এই বিস্তর বিতর্কের অবসরে চলুন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা মেহের উন নিসা বেগম সম্পর্কে কিছুটা জেনে আসি। তিনি ঘসেটি বিবি ও ছোটি বেগম নামেও পরিচিত ছিলেন। মতিঝিলে বাস করতেন বলে লোকে তাকে মতিঝিলের বেগমও বলত।

সিরাজের পিতা জৈনুদ্দীন ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আফগানদের হাতে নিহত হন। এই সময়ে হাজী আহম্মদেরও মৃত্যু হয়। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে আলিবর্দি খাঁ দুই ভ্রাতুষ্পুত্রের দাবি উপেক্ষা করে দৌহিত্র সিরাজকেই রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই নওয়াজিশের মন্ত্রী হোসেনকুলি খাঁ সিরাজের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করলেন। এই সময়ে ফজলকুলি খাঁর অকালমৃত্যুতে নওয়াজিশ একেবারেই অবসন্ন হয়ে পড়লেন। রাজনৈতিক ব্যাপারে তার যোগদান করার অভিলাষ সে সময় আদৌ ছিল না। ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। ঘসেটির চেষ্টাতেই হোসেনকুলি রাজ্যের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন; কিন্তু ক্রমে ক্রমে তিনি ঘসেটিকে ত্যাগ করে তার ভগিনী আমিনার প্রতি আকৃষ্ট হলে ঘসেটি তার একজন প্রধান শত্রু হয়ে পড়েন।

ঘসেটির এবং নিজ মাতা আমিনার কলঙ্ককাহিনি সিরাজকে মর্মাহত করেছিল। এই কলঙ্ক দূর করার জন্য তিনি মাতামহীর শরণাপন্ন হন। আলিবর্দি বেগম হোসেকুলির বধের জন্য স্বামীর অনুমতি ভিক্ষা করেন; কিন্তু এই কাজে নওয়াজিশের অনুমতি প্রয়োজন। ঘসেটিও এই সুযোগে স্বীয় অবিশ্বাসী প্রেমিকের কৃতকর্মের প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ পেলেন। তিনি হোসেনকুলিকে ধরাধাম থেকে অপসারিত করার জন্য নওয়াজিশের অনুমতি গ্রহণ করেন। ফলত সিরাজকে বাধা দেওয়ার দুজন মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জীবিত রইলেন। প্রথম—ঘসেটি বেগম।  দ্বিতীয়- সৈয়দ আহম্মদের পুত্র পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জং। আলিবর্দি খাঁ দেওয়ান রায়দুর্লভকে আগেই হস্তগত করেছিলেন। রায়দুর্লভকে তিনি উপঢৌকন দিয়ে এবং মীর জাফরকে কোরান শরিফ স্পর্শ করিয়ে শপথপূর্বক সিরাজের পক্ষাবলম্বন করিয়েছিলেন। ঘসেটির সঙ্গে সিরাজের যাতে কোনো সংঘর্ষ না ঘটে সেজন্য আলিবর্দি খাঁ বিশেষরূপে চেষ্টা করেছিলেন। এই সময় ৮২ বছর বয়সে উদরীরোগে আলিবর্দি খাঁর মৃত্যু হয়।

আলিবর্দির মৃত্যুর কিছুকাল আগে থেকেই বাংলার শাসনভার সিরাজের হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। তখন তিনি ঘসেটি বেগমের বিশ্বস্ত অনুচর নাজির আলির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনলেন এবং তার শাস্তি কামনা করে বেগম সাহেবার কাছে অনুরোধ পাঠালেন। বলা বাহুল্য, ঘসেটি এ প্রস্তাবে কর্ণপাত করলেন না। তখন থেকে সিরাজ ও ঘসেটি, উভয়ের মধ্যে বিবাদ চরমে উঠল। বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি তখন জীবিত। তিনি এই বিবাদ মিটাবার প্রাণপণে চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারেননি। এই ঘটনার পর থেকে ঘসেটি বেগমের ধারণা হলো যে, পিতার মৃত্যুর পর সিরাজ মসনদে উপবিষ্ট হয়ে নিশ্চয়ই তার ওপর অত্যাচার করবে ও সমস্ত ধনসম্পত্তি বলপূর্বক আত্মসাৎ করবে। এই আশঙ্কায় ঘসেটি বেগম রাজা রাজবল্ল­ভ, মীর নাজির আলি ও কতিপয় বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে মতিঝিল প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্বীয় সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্যে বিশ হাজার সৈন্যও সংগ্রহ করেন। এই সমস্ত উদ্যোগ-আয়োজন বিষয়ে তার পরলোকগত স্বামীর বিশ্বস্ত দেওয়ান, ঢাকার রাজা রাজবল্ল­ভ তার প্রধান সহায় ছিলেন। 

ঘসেটি মুক্তিলাভ করে মীর জাফর, জগৎশেঠ ও রাজবল্লভের সঙ্গে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। তখন তিনি নিজের পক্ষ সমর্থন করার জন্য লোকসংগ্রহে সচেষ্ট হলেন এবং কেমন করে তিনি সিরাজের হৃতসর্বস্বা হয়েছেন, কেমন করে তিনি সিরাজের হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন, তার অমানুষিক কাহিনি বিবৃত করতে লাগলেন। ঘসেটি মতিঝিলের একটি গুপ্ত স্থানে বহু ধনরতœ লুক্কায়িত রেখেছিলেন; তার কিছু অংশ মীর জাফরকে পাঠিয়ে দিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজদের নানারূপে বুঝিয়ে তাদেরও হস্তগত করলেন। এই সমস্ত ব্যাপারের কথা যথাসময়ে সিরাজের কানে উঠল- এরই ফলে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিবাদ ঘটে। এই বিবাদের পরিণাম ইতিহাসজ্ঞমাত্রই অবগত আছেন।

শ্রীপারাবতের লেখা আমি সিরাজের বেগম গ্রন্থে ঘসেটি বেগমকে বলা হয়েছে ‘সুন্দরী’, ‘আভিজাত্যপূর্ণ’, ‘চতুর’, ‘বদমেজাজি’ ও ‘উচ্চাভিলাষী’ হিসেবে। হিরাঝিলের একমাত্র শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নারী চরিত্র, যার আলাদা একটি প্রাসাদ ছিল। হিরাঝিলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে যার নাম রাখা হয় ‘মতিঝিল’। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা, তার দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব, এবং সুযোগসন্ধানী মনোভাব তাকে আর দশটা নারী থেকে পৃথক করেছিল। কেউ কেউ বলেন, রাজবল্ল­ভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দেওয়াই ইংরেজের সঙ্গে সিরাজের সংঘর্ষের প্রধান কারণ। কৃষ্ণদাসের কাছে নাকি ঘসেটির বহু অর্থ ছিল। হলওয়েল সাহেব ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা থেকে মোরাদবাগে ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেবকে ঘসেটির শেষ পরিণামের উল্লেখ করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। 

পলাশীর যুদ্ধের পর ঘসেটি ও আমিনাকে বন্দি করে ঢাকায় প্রেরণ করা হলো। মীর জাফর আলিবর্দির বংশের উচ্ছেদ সাধনে ঢাকার শাসনকর্তা জেসারৎ খাঁকে তাদের হত্যা করতে লিখে পাঠালেন। এই পত্র পেয়ে জেসারৎ খাঁ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। যাদের অন্নে লালিত-পালিত হয়েছেন, যাদের কৃপায় উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হয়েছেন তাদের হত্যা করতে হবে ভেবে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। মীর জাফরের চিঠির উত্তরে তিনি নিজের অসম্মতি জানালেন। তখন মীর জাফর একজন বিশ্বস্ত জমাদারকে শহরের দুই মাইল দূরে মধ্যরাতে কোনো নির্জন স্থানে নদীবক্ষে বেগমদের ডুবিয়ে মারতে আদেশ করলেন। তার আগে তিনি জেসারৎ খাঁকে তার হাতে বেগমদের সমর্পণ করার জন্য এক পরোয়ানা পাঠালেন। বেগমেরা নির্দিষ্ট স্থানে উপনীত হলে উভয়ের পায়ে পাথর বেঁধে দিয়ে তাদের নদীতে ছুড়ে ফেলা হলো। উপায়ান্তর না দেখে বেগমেরা যখন প্রাণ রক্ষার্থে নৌকার পাশ ধরে কোনোক্রমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন, তখন নির্মম জমাদার তাদের মস্তকের ওপর লগি দিয়ে আঘাত করতে লাগল; কিন্তু রক্তাক্ত হয়েও যখন তারা শেষ অবলম্বনটুকুর আশা ত্যাগ করলেন না, তখন হাত কেটে দিয়ে তাদের ডুবিয়ে দেওয়া হলো। ইতিহাস ক্ষমা করে না কাউকেই। এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক গঠন নিয়ে বেড়ে ওঠা ঘসেটি বেগমের জীবনাবসানও হয়েছিল করুণ এক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে মানুষের ঘৃণা আর অবজ্ঞাই কুড়িয়েছেন শেষাবধি। ১৭৬০ সালে পানিতে ডুবিয়ে হত্যার আগ অব্দি তিনি বুড়িগঙ্গা থেকে কয়েকশ গজ দূরে জিঞ্জিরা প্রাসাদেই অবস্থান করেছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //