যে ফুল ঝরে গেছে বনে

কখনো মনে হয় ঈর্ষাও অপ্রাপ্তির মতো সুন্দর। যে ঈর্ষায় জড়িয়ে থাকে অব্যক্ত প্রেম, মিহি স্বরে গাওয়া সংগীতের প্রলুব্ধকর আওয়াজ। অবিমিশ্র এক স্বর্গীয় ধ্বনি। তাই বুঝি, আজকাল প্রায়শই মনে হয়, মনুষ্যজাত ছাড়া জগতের নানাবিধ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা মেলে সুন্দরের। ঈর্ষার মতো অপূর্বের।

যেমন- যে ফুল ঝরে গেছে বনে, যে পাখির চোখ শুকিয়ে গেছে অপেক্ষায়, যে প্রজাপতি ম্লান হয়ে বসে আছে ফুলের নিমগ্ন বক্ষে- তাদের সকলের প্রতিই আমার কোমল ঈর্ষা আছে। হৃদয়টা ব্যাকুল হয়ে ওঠে তাদের অকৃত্রিম যাপনের কথা ভাবলে। সেই সঙ্গে মনে হয় আয়ুর কথাও। ভাবি, এত দীর্ঘ একটা জীবন! এত দুঃসহ একটা যাত্রা! কোথায় যে এর আদি-অন্ত তা-ই জানি না! তারচেয়ে বরং একটি পল্লব হলে ভালো হতো। সবুজ গাছের ডগায়, পাখির পায়ের পাতায় কিংবা যে কোনো কুঁড়ির গায়ে ধীরে ধীরে জড়িয়া যাওয়া যেত। তারপর হঠাৎ সময় হলে কিংবা ঋতুর পালাবদলে নির্বিঘ্নে মারা যেতাম। কেউ জানতও না। কেউ ডাকতও না। তদুপরি কারও করুণার কাছে নতজানু হয়ে বসতেও হতো না।

এসব কথা ভাবলে চোখের ওপর ভেসে ওঠে একটা দৃশ্যহীন জগৎ। যেখানে কেবলই আপন চিন্তার মর্মান্তিক কিছু অমসৃণ কথারা দোল খায়; কিন্তু সেই দোল কিংবা উদ্বেল কথাদের কাছে কোনোক্রমেই যেতে পারি না আমি। যদিওবা বহু ক্রোশ অতিক্রম করে কখনো ছুঁতে যাই, মনে হয়, পৌরাণিক প্রলেপের মতো তা আমার ইন্দ্রিয় থেকে দূর, বহুদূর ছুটে যায়। তখন ভাসমান কুয়াশার মতো আমি এক আবছা হয়েই রয়ে যাই শুধু। সেখানে না থাকি আমি, না থাকে আমার কোনোরূপ অস্তিত্ব। 

মূলত বোধের এই বিজড়িত ভাবনারা কোথা থেকে যেন জালের মতো আমার সর্বাঙ্গে বিছিয়ে রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে। অগুনতি রাত্রির আঁকড়ে নিদ্রাহীন শুয়ে থেকে থেকে সেই প্রলম্বিত জালের অজস্র ছিদ্র গুনেছি আমি। সেখানে আছে জয়, পরাজয়, সাহস, ভীরুতা, মগ্নতা, বিচ্ছিন্নতা, প্রেম, যুদ্ধ, ঈশ্বর কিংবা জগতের যাবতীয় জড়-অজড়ত্বের সর্বগ্রাসী আবাস। সেখানে, সেই বিভ্রমের মাঝে বিলীন হতে হতে যখন নিজের সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দেওয়া যায়, তখনই মনে হয় স্বর্গ ছেড়ে কোনো দেবদূত নেমে এসেছে। আজানুলম্বিত সুকোমল হাতে স্পর্শ করছে আমার চিবুক। আর আমার শবদেহের পাশে নিঃশব্দে রাখছে কয়েকটি ফুলের মুকুল।

অদৃশ্যের মাঝে নিজেকে তখন আরও জীবন্ত মনে হয়। মনে হয়, চরাচরজুড়ে আমার যা শূন্যতা ছিল, কল্পনায় আমি তা স্পর্শ করছি। আমি স্পর্শ করছি কেবলই মানুষের মমতা। যে মমতার জন্য সমস্ত জীবন ছুটে চলেছি। কারও কাছ থেকে একটু ভণিতাহীন আদরের জন্য কত অজস্র মাইল যে হেঁটেছি, তা জানে কেবলই আমার দুটি পা আর একটা মাত্র হৃদয়। অথচ এই সবকিছু থেকে যখন ক্রমাগত বঞ্চিত অনুভব করেছি, কিংবা ধরে ফেলেছি মানুষের ভণিতা- তখন না পাওয়ার যাবতীয় কষ্ট ব্যর্থতায় রূপান্তর হয়ে বেদনাদের দিয়েছে দ্বিগুণ ঐশ্বর্য। সেই দুঃখপূর্ণ ঐশ্বর্যে নিপতিত হয়ে কোন পথে কোন ঘাটে যে ঘুরে বেড়িয়েছি, তার আর হদিস করতে পারি না আজ। ফলে মাঝে মাঝে ভাবি জগতের প্রতি, জীবনের প্রতি এমনকি সমস্ত প্রিয় মানুষের প্রতি আমার যে কোমল স্নিগ্ধ একটা ঈর্ষা আছে, কখনো মনে হয় সেই ঈর্ষাগুলো সত্যিই অপ্রাপ্তির মতো সুন্দর। কেননা বহু ভেবে দেখেছি, প্রাপ্তির আনন্দের চেয়ে অপ্রাপ্তির যে দুঃখ- তাতে মূলত অব্যক্ত, অস্পৃশ্য এবং অফুরন্ত এক বেদনাবিধুর সুখই লেপ্টে থাকে। আপন চিন্তায়, হৃদয়স্থ শোকের ভেতর সেই অপ্রাপ্তিগুলো ভীষণ আভরণে জেগে থাকে। তাতে যখন ইচ্ছে একবার ঢুঁ মেরে নিজের শোকের কাছে আনত হওয়া যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //