দস্তয়েভস্কির গল্প থেকে সিনেমা

সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র দুটি আলাদা শিল্প হলেও ঠিক কতখানি আলাদা তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। তারা কি দুই ভাইয়ের মতো আলাদা? দুই বন্ধু বা প্রতিবেশীর মতো? নাকি দুই প্রতিযোগীর মতো আলাদা? সেভাবে বলতে গেলে বলতে হবে চলচ্চিত্র প্রথমে এসেছিল সাহিত্যের হাত ধরেই। ১৮৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে ১২৭ বছরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে চলচ্চিত্র শিল্প।

শুরুর দিককার শুধু নড়াচড়া কিংবা ছোট ছোট স্ক্রিপ্টের চলচ্চিত্রের পর যখনই কাহিনি চিত্র বানানো শুরু হলো তখনই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরা। এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের, এরিক মারিয়া রেমার্কদের মতন বিখ্যাত লেখকেরা তো সরাসরি হলিউডে গিয়ে বসতিই গড়েছেন। তারপর শুরু হয়েছে ছোটগল্প ও উপন্যাসকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণের। সিনেমা এবং সাহিত্য; দুই স্বকীয় মাধ্যম একাত্ম হয়ে নির্মিত হয়েছে কালজয়ী বহু চলচ্চিত্র।

তেমনই একটা দারুণ উদাহরণ ফিওদর দস্তয়েভস্কির ছোটগল্প ‘লে নোত্তি বিয়াংকে’ ইংরেজি অনুবাদে যার নাম হয় ‘হোয়াইট নাইটস’। দস্তয়েভস্কির বিখ্যাত এই ছোটগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বহু ভাষায় বহু চলচ্চিত্র। ছোটগল্পটি অবলম্বনে আমাদের উপমহাদেশেও নির্মিত হয়েছে বেশকিছু চলচ্চিত্র। যার মধ্যে ২০০৭ সালে ভারতে নির্মিত সঞ্জয় লীলা বানসালি পরিচালিত ‘সাওয়ারিয়া’ চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য। এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই বলিউডে পদার্পণ করেন রণবীর কাপুর ও সোনম কাপুর। গান, সেট ও প্রোডাকশন ডিজাইন এবং কলাকুশলীদের অভিনয়ের জন্য প্রশংসা পেলেও চিত্রনাট্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল। 

তবে ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজমের পুরোধা ব্যক্তিত্ব লুকিনো ভিসকন্তি ১৯৫৭ সালে ‘লে নোত্তি বিয়াংকে’ নামেই প্রথম এই গল্পটি থেকে সিনেমা নির্মাণ করেন। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কীভাবে শ্রমিকশ্রেণিকে অপরাধীতে রূপান্তর করে- এমন গল্প নিয়ে ভিসকন্তি তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘অবসেশন’ (১৯৪৩) নির্মাণ করেন । অবসেশনকে বলা হয়ে থাকে ‘ইতালিয়ান নিওরিয়ালিস্ট’ মুভমেন্টের প্রথম চলচ্চিত্র। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কীভাবে শ্রমিকশ্রেণিকে অপরাধীতে রূপান্তর করে, তা নিয়ে ছিল চলচ্চিত্রটি। 

গল্পটি মূলত দুটি নিঃসঙ্গ প্রাণের। একজন মারিও; শহরে বহিরাগত। নতুন এসেছে। স্বভাবের দিক থেকেও বেশ অন্তর্মুখী। ফলে ভুগছে একাকিত্বে। অপরদিকে সুন্দরী নাটালিয়া, সেও নিঃসঙ্গ। তার মেজাজি দাদির কারণে কখনো অন্যের মেশার সুযোগ হয়নি। সব সময় তটস্থ থেকেছে রক্ষণাত্মক দাদির ভয়ে। তবুও প্রায়শই নাটালিয়া দাদির অগোচরে রাতে বেরিয়ে পড়ে শহর ঘুরে দেখতে। নাটালিয়ার সঙ্গে মারিওর দেখা হয়েছিল ব্রিজের ওপর। শহরের সেন্ট্রাল ব্রিজ। সেই ব্রিজও বারবার ঘুরেফিরে এই সিনেমায় আসে। ব্রিজ, হাওয়ার শব্দ, ছবির মতো সুন্দর খাল, কুয়াশা কেটে সামনে আগ্রসর হওয়া কিংবা মাদকতাপূর্ণ তুষারপাতের দৃশ্য; দর্শকমনে রূপকথার অনুভূতি দেয়। কনকনে শীতের সেই রাতে, নাটালিয়াকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় মারিওর। পড়ে যায় প্রেমে।

বিষাদগ্রস্ত নাটালিয়া প্রেমে পড়েছিল এক আগন্তুকের। যে এক বছর আগে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠেছিল নাটালিয়াদের বাড়িতে। কথা দিয়েছিল ফিরে আসবে এক বছর পর। এমন বিষাদগ্রস্ত সময়ে ভগ্ন হৃদয়ের নাটালিয়ার খুঁটি হয় মারিও। তারা ঘুরতে থাকে প্লেটোনিক ভালোবাসার আবর্তনে। নাটালিয়া তার দ্বন্দ্ব থেকে স্থির হতে পারে না। তার মন পড়ে আছে সুদূরপুরের সেই আগন্তুকের কাছে। যখন মনের স্থিরতা আসে, অকস্মাৎ তখনই ফিরে আসে সেই আগন্তুক! মারিওর উবে যাওয়া একাকিত্ব ফিরে আসে। কুয়াশার মতো জেঁকে বসে চারদিকে। এক অমোঘ মুহূর্তের সূচনা হয় তখন। 

চলচ্চিত্রে দস্তয়েভস্কির গল্পের নাটালিয়া চরিত্রকে আরো দ্বন্দ্বমুখর এবং সমাপ্তিকে আরও বিষাদময় করে অপূর্ব এক রূপ দিয়েছেন ভিসকন্তি। অতি সূক্ষ্মভাবে নিওরিয়ালিজমের ছোঁয়ার সঙ্গে গাঢ় হয়ে থাকা আমেরিকান মেলোড্রামার আবেদন এই সিনেমার সমাপ্তিকে করেছে হৃদয় নিংড়ানো। নিওরিয়ালিস্ট সিনেমা দিয়ে নির্মাণ শুরু করা ভিসকন্তি পরবর্তী সময়ে এপিক, ঐশ্বর্যময় গল্পের দিকে ভিড়তে থাকেন। যার শুরুটাও হয় এই চলচ্চিত্র থেকে। 

এই চলচ্চিত্রের চিত্রধারণ করা হয়েছে সেটে। সেট ডিজাইন, আলো-ছায়ার অনবদ্য বণ্টন, ফ্রেমিং এবং কম্পোজিশনের অপূর্ব ব্যবহারের সঙ্গে দুটি নিঃসঙ্গ চরিত্রের সামাজিক অবস্থান, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও বিশ্লেষণ, আকাঙ্ক্ষা; চলচ্চিত্রটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তার সঙ্গে গল্পের চরিত্র দুটোকে মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ানি এবং মারিয়া শেল এত সহজাতভাবে রূপায়ণ করেছেন, সেটাও বিস্মিত হওয়ার বিষয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //