স্মৃতিকথা

তোমার প্রসন্ন হাসি

ছাপ্পান্ন বছর আগের কথা। আগস্ট ১৯৬৭ সাল, রবিবার। জগন্নাথ হলের কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বাসস্থান। উঁচু একটি দালান। তার ঠিক পাশ ঘেঁষে শিবমন্দির। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দুলির সঙ্গে সেদিন সেই শিবমন্দিরে গিয়েছিলাম! পুরোহিতের কাছে হাত দেখাতে। হাত দেখা বা শিবঠাকুর কোনোটাতেই তেমন বিশ্বাস ছিল না। এমনকি তখনও। সবচেয়ে বড় কথা সেদিনই প্রথম বাবার নির্দেশ অমান্য করে শিক্ষালয় ও হোস্টেলের বাইরে অন্যত্র পা দিয়েছিলাম। জানতাম না তখনও, পা দিয়েছিলাম অন্য জগতের দুয়ারে। বাবার সেই আদেশের সামান্য অমান্য কী অসামান্যভাবে আমার জীবন বদলে দিল।

আমি ঢাকায় পড়তে আসি ১৯৬৫ সালে। বকশীবাজার গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে। ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি তখনও যথেষ্ট জ্বলন্ত। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা স্বভাবতই নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছে। তারই ভেতর ঘটে গেছে ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ। আত্মীয়স্বজন হিতাকাঙ্ক্ষী সকলের উপদেশ অমান্য করে স্থানীয় অভিভাবকহীন অবস্থায় বাবা আমাকে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন একটা শর্তে। হোস্টেল ও কলেজ ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না। ইন্টারমিডিয়েট কলেজের হোস্টেল তখন ছিল ইডেন হোস্টেলের সঙ্গে আজিমপুরে।

সে একটি সময় বটে। কৈশোর যৌবনের সেই সন্ধিক্ষণে প্রতিটি মানুষই বোধহয় এমন এক পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যায়। অসম্ভব খজু চিন্তায় ও কর্মে। যা কিছু তখন গ্রহণ করা হয় সম্পূর্ণ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করা হয়। আর যা বর্জন করা হয় তাও সম্পূর্ণভাবেই। আমি বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম। কোথাও যাইনি কখনও। অথচ সেদিন গিয়েছিলাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে অনার্স পড়ছি। থাকি রোকেয়া হলে।

শিবমন্দির থেকে ফেরার পথে মন্দিরের পাশে তিন রাস্তার কোনায় যে লাল রঙের দালানটি, তারই সামনে প্রথম তার সঙ্গে দেখা হলো আমার। বাড়ির সামনে বাঁধানো লম্বা রাস্তাটিতে খুব দ্রুত পায়চারি করছেন তিনি। পরনে ধুতি ও গেঞ্জি।

দুলি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘দাদু! চল, যাবি।’

আমি কিছু যেন চিন্তা করতে পারছিলাম না। মোহগ্রস্তের মতো দুলিকে অনুসরণ করলাম। লোহার গেট পার হয়ে সেই মহামানবের সামনে এসে দাঁড়ালাম জীবনে প্রথমবারের মতো। একেবারে মুখোমুখি। দুলি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি মুখ তুলে তাকালাম তার দিকে! দেখলাম সেই অবিশ্বাস্য হাসি। শুধু তার সারা শরীর নয়, চারদিকে সবকিছু যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেই হাসিতে। এত সরল, পবিত্র, এত খোলামেলা, এত পরিপূর্ণ হাসি আমি আর কারো মুখে কোনোদিন দেখিনি। পড়ন্ত বেলায় ওই মুখে সেই হাসি দেখে এক নজরেই আমি বুঝেছিলাম তিনি আমার পরমাত্মীয়। এই ঘটনার এক মাসের ভেতরই অবশ্য সেই ব্যক্তিটির সঙ্গেও আমার পরিচয় হয় যার হাসি কখনও কখনও আমাকে আনমনা করে-হঠাৎ করে মনে করিয়ে দেয় অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সেই দুর্লভ হাসিটির কথা।

আমি যার কথা বলছি এখন তিনি অগ্রজপ্রতিম হায়াৎ মামুদ, আমার স্বামীর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু।

দুলির বাড়ি দিনাজপুর। ওর বাবা তখনও দিনাজপুর কলেজের অফিসে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধে তাকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল। ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেব দিনাজপুর কলেজে প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থাতেই দুলির বাবা এ কলেজে ঢুকেছিলেন। তখন থেকেই চেনাজানা দুই পরিবারের। ঢাকায় যখন পড়তে এলো দুলি, তার বাবার অনুরোধে ড. দেব ওর স্থানীয় অভিভাবক হতে রাজি হয়েছিলেন। সেই হিসেবে মাঝে মাঝে, এ বাসায় যেত দুলি।

আমার সঙ্গে যখন তার দেখা হলো, মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছেন। ফুলব্রাইট প্রফেসর হিসেবে পেনসিলভেনিয়ার উইলক্সবেরি কলেজে দশ মাস পড়িয়ে সদ্য আবার দেশে ফিরেছেন। কাগজে তার ছবিসহ আমেরিকা ভ্রমণের সংবাদ পড়েছি। অবশ্য তার কথা এর আগেও বিস্তর শুনেছি। আত্মভোলা, প্রখর জ্ঞানী, চিরকুমার, দয়ালু এই প্রফেসরটির কথা কে না জানে বিশ্ববিদ্যালয়ে? জীবিত অবস্থাতেই কিংবদন্তি হয়ে পড়েছিলেন এই শিক্ষকটি যার মাথার অজস্র পাকা চুল সর্বত্রই উষ্কখুষ্ক, অথবা বাচ্চাদের মতো সামনে কপালের উপর টেনে আঁচড়ানো। তাকে দেখার ইচ্ছা আমার সেই অনেকদিনের। অথচ বাবার সেই শর্তের কথা ভেবে কখনও দু’পা দূরের সেই বাসায় যাবার কথা ভাবিনি। বহু বাধা, বহু বেড়া, বহু উপদেশ ডিঙিয়ে, করণীয়-অকরণীয়ের সূক্ষ্ম বিভেদ ভুলে কিছু কিছু নিষিদ্ধ ও অবাঞ্ছনীয় বক্তব্য ও কর্মে অংশগ্রহণ করার সময় আজ মনে মনে ভাবি কতই না সহজ আর জটিল ছিল সে জীবন। কারো কথায় সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে চোখ বুজে তা মেনে চলা কতই না নিরুদ্বেগের। তিনি সেদিন যেভাবে পায়চারি করছিলেন তাতে আমি ভেবেছিলাম কোনো কারণে তিনি চঞ্চল অথবা বিষণ্ণ। পরে অবশ্য জেনেছিলাম ওটা তার দৈনিক স্বাস্থ্যচর্চারই অংশ মাত্র। এছাড়া পায়চারি করার সময় তিনি চিন্তা করার সুযোগও পেতেন। অনেক দিন ধরেই বহুমূত্র রোগের শিকার তিনি। নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ, সময়মতো চেকআপ ও দৈনন্দিন হাঁটা, এসব কিছুই তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলতেন। কারণ বাঁচার, বিশেষ করে সুস্থ, কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকার বড় আগ্রহ ছিল তার। মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘বুড়ো বটগাছ হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।’ জীবন কর্মময়এ কথা তার মুখে বহুবার শুনেছি।

তার ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে আমাকে ও দুলিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন তিনি। বাইরের ঘরে কেউ ছিল না। খুব নিরাভরণ সে ঘর। গোটা চারেক বেতের চেয়ার, একটি বেতের টেবিল ঘরের ডানদিকে। বাঁ দিকে একটি বড় চৌকো কাঠের টেবিল। সঙ্গে একটি চেয়ার। এ ঘর পেরিয়ে ভেতরে খাবারের ঘরে ঢোকার দরজার ঠিক ওপরে সেই জগৎ ভোলানো হাসি সমেত তার একখানা বড় ছবি। নিচে লেখা ‘৭ মার্চ, ১৯৬০। জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য।’ আমরা তিনজন খাবারের ঘরে ঢুকলাম। একটি বড় গামলায় রাখা উত্তপ্ত গরম জলের বাষ্পের ওপর মাথা গুঁজে, তোয়ালে চাপা দিয়ে বসে আছে যে লোক, তার মুখ দেখার কোনো উপায় ছিল না আমাদের। তিনি ডাকেন, ‘জ্যোতি, এই জ্যোতি! দেখ কে এসেছে?’

তোয়ালেটা মাথায় তুলে মুখ উঠাল জ্যোতি। পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি তার ছেলের সঙ্গে। সেই প্রথম দেখা জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে, যার সঙ্গে আজ ২৫ বছর ঘর করছি। প্রচণ্ড সর্দি লেগেছিল জ্যোতির সেদিন। নাক লাল, মুখ ফোলা ফোলা।

দুলির কাছে এই তরুণ লেখকটির গল্পও আমি শুনেছি। ওর একটি বইও দুলি দেখিয়েছিল আমায়। গল্পগুলো পড়ে ওকে বুঝিয়ে দিতে বলেছিল যাতে পরবর্তীকালে গিয়ে সেগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। জ্যোতির সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক দিন আগেই Pakistan Observer-এর রবিবারের ম্যাগাজিনে ওর একটি অনুবাদ পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম।

কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম ছোটবেলায় আমার ভাইটির জন্মদিনে যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের লেখা কিশোর উপন্যাস ‘কুয়াশা’ বইটি কিনে দিয়েছিলাম, সেই জ্যোতিপ্রকাশ দত্তই তিনি কিনা। সলজ্জ হেসে জ্যোতি জানাল সে-ই সে ব্যক্তি। ছাত্রাবস্থায় আর্থিক অনটনের কারণে ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সের অনুরোধে বইটি লিখেছিল সে। তার বিনয়ের কারণ খুব বোধগম্য হলো না আমার। কেননা আমার স্পষ্ট মনে আছে বইটি খুবই পছন্দ হয়েছিল আমার এবং আমার সহপাঠিনীদের।

বিদায় নেবার আগে ড. দেব ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত পরের রবিবার আবার আমাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবার প্রতিশ্রুতিও দিল জ্যোতি।

পরের রবিবার আবার সেই নিষেধের কথা ভুলে ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের সেই লাল দালানটায় গিয়েছিলাম দুলির সঙ্গে। জানি না সেটা কিসের আকর্ষণে। সম্পূর্ণ অন্যরকম নিশ্চুপ, একাকী ওই পুরনো বাড়িটির, তার অধিকারী সেই জ্ঞান তপস্বীর না সদ্য প্রতিষ্ঠিত তরুণ লেখকটির।

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত রান্না করেছিল ঠিকই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। তাই খিচুড়ি রান্না করেছিল জ্যোতি। বেশ ঝোলা খিচুড়ি। রান্না সে ভালোই করতে পারে, পরবর্তী জীবনে যা জানার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু তার প্রথম রান্না খেয়ে বোঝার উপায় ছিল না। আমাদের চেয়ে পিতাপুত্রই রান্নায় পরিতৃত্তি প্রকাশ করছিলেন বেশি। বাকি রান্নাগুলো করেছিল বাড়ির রাঁধুনি মধু।

সেদিন ঘণ্টাতিনেক সময় যখন ছিলাম, আমার সঙ্গে অনেক কথাই বললেন ড. দেব। আমার পরিবার, মুন্সীগঞ্জ শহর, পড়াশোনা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ইত্যাদি নানান বিষয়ে। খাবার কিছুক্ষণ পর তিনি তার শোয়ার ঘরে গেলেন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। আমি ও দুলি আরও কিছুক্ষণ বাইরের ঘরে বসে জ্যোতির সঙ্গে গল্প করলাম। করলাম মানে বলা চলে মুগ্ধ হয়ে শুনলাম জ্যোতির কথা। লক্ষ করলাম খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে সে।

এরপর জ্যোতি ও ড. দেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল অকস্মাৎ সামান্য সময়ের জন্য। তাদের বাড়ির সামনে গেটের কাছে। সেটা ছিল ৩০ আগস্ট, বুধবার। সায়েন্স অ্যানেক্সে স্ট্যাটিস্টিকস ক্লাস সেরে হলে ফিরছিলাম। রাস্তা থেকেই দেখতে পেলাম জ্যোতিকে। যতদূর মনে পড়ে সেদিন ওদের ঘরে যাইনি।

তারপর আমার বিয়ের আগে মাত্র একবারই দেখা হয়েছিল ওদের সঙ্গে। সেটা ছিল সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ। জ্যোতি জানাল, ৩০ তারিখে সে আমেরিকা চলে যাচ্ছে পড়াশোনা করতে। যাবার আগে আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চায় সে। ড. দেবও এ ব্যাপারে তার ইচ্ছা ও আগ্রহ এবং জ্যোতির মনোভাব আমাকে একলা ডেকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন।

ড. দেবের মধ্যস্থতায় ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ রবিবার আমার বিয়ে হয়ে গেল। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জে। আমার তিন বছরের বড় বোন আরতি (ছোড়দি) তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবং অবিবাহিত। তার চোখের সামনে এমন তড়িঘড়ি করে বিবাহিত বনে যাবার গ্লানি মেনে নিতে অনেকটাই সময় লেগেছিল আমার। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেই সময় বিয়েতে আমার মত ছিল না। পরে সেটা জানতে পেরে শ্বশুর ও জ্যোতি উভয়েই দুঃখ প্রকাশ করেছিল। প্রথম শ্বশুরঘরে পদার্পণ উপলক্ষে নববধূ বরণের বিশদ আয়োজন বোনদের সকলের বিয়েতেই দেখেছি। আমি তাই অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম যখন বিয়ের পর প্রথম জ্যোতি, শ্বশুর ও দুলির সঙ্গে এ বাড়িতে এসে দরজায় কড়া নাড়াতে হয়েছিল। আমি নিরাশ হয়ে লক্ষ করলাম চোখ কচলাতে কচলাতে ভৃত্য মদন এসে দরজা খুলে দিল। আর নববধূসহ সকলে গট্ গট্ করে ঘরে ঢুকে গেল অন্য যে কোনো সাধারণ দিনের মতো। কিন্তু আমার সেই খারাপ লাগা কেবল এক মুহূর্তের জন্যই। এ বাড়ি ও তার অধিবাসীরা সঙ্গে সঙ্গেই এত আপন করে নিয়েছিল আমায় যে আনুষ্ঠানিক বধূবরণের মাধ্যমেও যা অনেকের কপালে জোটে না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম শ্বশুর আমাকে ‘বৌমা’ বলে ডাকতেন কিন্তু কিছুদিন পরই তিনি কেবল ‘মা’ অথবা ‘ও মা’ বলে সম্বোধন করতেন আমায়।

বিয়ের পাঁচ দিন পর নির্ধারিত দিনে (৩০ সেপ্টেম্বর) জ্যোতি চলে গেল আমেরিকা। সেদিন শ্বশুরকে বড়ই বিষণ্ণ লাগছিল। এত দিন পর হঠাৎ একা হয়ে পড়েছেন তিনি। আমার স্বামীকে পুত্রস্নেহে কাছে ডেকে আনার পর এই বোধ হয় প্রথম সত্যিকারের বিচ্ছেদ। আমি তখনও ভালো করে বুঝতে পারছি না কী ঘটে গেল আমার জীবনে। গত ছ’টি সপ্তাহ যেন সাইক্লোনের বেগে প্রচুর ঘটনা ঘটে গেল একের পর এক।

অবসন্ন শরীরের বৃদ্ধ শ্বশুরকে নিয়ে আবার ওই একাকী লাল দালানটিতে ফিরে এলাম। এরপর ওই বাড়িতে আরও ১৬ মাস কেটেছে আমার তার সঙ্গে। যে লোককে দূর থেকে দেখে সবাই মাথা নত করে, আমি তাকে প্রাত্যহিক জীবনে-সাংসারিক নানান কাজের মধ্যে প্রতিমুহূর্তে দেখেও বার বার মাথা নুইয়েছি।

সংসার না করেও মোটামুটি সংসারী ছিলেন তিনি। একেবারে উদাসীন ছিলেন না দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সাংসারিক 

কাজে-কর্মে। জাগতিক ও সাংসারিক নানা বিষয়ে তার জ্ঞান ও বিচক্ষণতা ছিল অপরিসীম। তার পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা তাই ভাবতে পারতাম না। নিজে জীবনে যা পাননি বা নেননি অন্যে তা গ্রহণ করলে তিনি তৃপ্তই হতেন। নিজে যদিও চিরকুমার, অন্যের বিয়ের ঘটকালি করতে প্রচুর উৎসাহ ছিল তার। নিজের হাতে অন্যদের মিষ্টি খাওয়াতেন, যদিও ডায়বেটিসের কারণে পছন্দ করা সত্ত্বেও কখনও নিজে মিষ্টি খেতেন না। আমার বিয়ের দু’বছর পর বিয়ে হয় আমার সেই ছোড়দির। পাত্র নির্বাচন থেকে শুরু করে সেই বিয়ের যাবতীয় কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রধানত শ্বশুর ও জ্যোতি। আমাকে আগে আগে ঘরে তুলে নেওয়ার দায়ভার হয়তো কাজ করেছিল ওদের এই উৎসাহ ও উদ্দীপনার পেছনে।

প্রকাশিত বইগুলো ছাড়াও ড. দেবের লেখা নিয়মিত বেরুত খবরের কাগজে ও ম্যাগাজিনে। ইংরেজি ও বাংলা দুটো ভাষাতেই তার দখল ছিল সমান। কিন্তু তার কোনো রচনাই তিনি নিজের হাতে লিখতেন না। চিন্তায় ব্যাঘাত হতো হয়তো। জ্যোতি একসময় তার প্রায় সব লেখার ডিকটেশন নিত। ও চলে যাবার পর শ্বশুরের ছাত্র জলিল সাহেব নিতেন নিয়মিত। তার Parabales of the East-এর ডিকটেশন অনেকটাই নিয়েছিলাম আমি। এখনও মনে পড়ে কিছু কিছু অপরিচিত শব্দ বুঝতে না পারলে, বানান জিজ্ঞেস করলে বা আবার বলতে বললে খুব বিরক্ত হতেন তিনি। ভাবনার খেই হারিয়ে যেত বলেই হয়তো। পরবর্তীকালে তাই শব্দটিকে যথাশ্রুতি ধরে রাখতাম। পরে সুযোগমতো জিজ্ঞেস করে সঠিক শব্দটি লিখে দিতাম।

এটা শুনে মনে হতে পারে তাকে আমি ভয় করতাম। কিন্তু না। একেবারেই না। তিনি এমনই এক ব্যক্তি যাকে কেউ বোধহয় ভয় করত না। ভয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধার যে কোনো যোগ নেই তাকে দেখে ভালো করেই সেটা বুঝেছি। তিনি আমাকে দর্শন পড়াবার চেষ্টা করেছেন এক সময়। একটি খাতা কিনে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন একটু একটু পড়াতেন, প্লেটো, অ্যারিস্টটল। কিন্তু বড় দেরিতে শুরু করেছিলাম। কিছু তেমন শিখতে পারিনি।

আমার বিয়ের ঠিক পরপরই তিনি তার একটি ব্যক্তিগত স্বপ্ন বা ইচ্ছার কথা বলেছিলেন আমায়। তিনি চাইতেন ঘর আলো করা ফুটফুটে একটি নাতনি। ঘুরঘুর পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবে। নাম হবে তার রাগিণী। আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে-তার সেই আকাঙ্ক্ষিত নাতনি। কিন্তু জন্মেছে বেশ কয়েক বছর পর। তাকে দেখার সুযোগ হয়নি তার। কিন্তু দাদুর দেওয়া নামেই মেয়ের নামকরণ হয়েছে জয়ীষা রাগিণী।

আমার বিয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর তিনি আবার একটি পারিবারিক জীবনের আস্বাদ পেয়েছিলেন। বিশেষ করে আমার বাবার বাড়ির পরিবারকে পেয়ে তিনি খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। ছুটি হলেই বা সময় পেলেই চলে যেতেন মুন্সীগঞ্জে। বাবাকে নাম (তরুণী) ধরে ডাকতেন। মাকে ডাকতেন বেয়ান বলে। আমার পরিবারের সকল সদস্যও তাকে পেয়ে ধন্য হয়েছিল। তিনি যে এতটা স্নেহশীল, এতটা ঘরোয়া ও পারিবারিক আমাদের সংসারে, তার যাতায়াত ও ব্যবহার না দেখলে বিশ্বাস হতো না। ধীরে ধীরে এমন হলো যে, আমাদের গোটা পরিবারের কোনো সিদ্ধান্তই আর তার অনুমোদন ছাড়া গ্রহণ করা হয় না। তিনি রাতারাতি আমাদের সমস্ত আত্মীয়স্বজনের অভিভাবক হয়ে গেলেন। তিনি কী খেতে ভালোবাসেন, কী করতে ভালোবাসেন, তাই নিয়ে সকলে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসত।

জ্যোতি ততদিনে টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে পরিবেশ বিজ্ঞানে (এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স) আমার ভর্তির ব্যবস্থা করে ফেলেছে। নতুন বিষয় ওটা। সবে সংযোজিত হয়েছে পাঠ্যক্রমে। ভর্তির সুযোগ পেলেই মাসে ২৫০ ডলারের স্কলারশিপ। তখনকার দিনে ২৫০ ডলার বেশ ভালো অঙ্কের বৃত্তি। কেমন করে জানি আমি সেটা পেয়ে গেলাম। জ্যোতি উত্তেজিত হয়ে সুসংবাদটি দিল আমায়। কিন্তু চিঠি পড়ে কেবল শ্বশুরই দেখি খুশি। এই বৃদ্ধকে একা এই বাড়িতে রেখে কেমন করে চলে যাব, বিশেষ করে সেখানে জ্যোতির অনুপস্থিতিই তিনি তখন পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। আমার বিদেশ যাবার ব্যাপারে অতি উৎসাহী মা-বাবাও বারণ করলেন আমাকে যেতে। তাদের স্পষ্ট কথা এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা হবে। বিশেষত যেখানে দেশে এখনও পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমি না যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

জ্যোতি প্রথমে একটু মনোক্ষুণ্ণ হলো। যৌথ জীবনের শুরুতেই আমি আমাদের দুজনের চেয়ে তৃতীয় ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিলাম (হলোই না সে ব্যক্তি অতিপ্রিয়, অতি আপনার)। এটা ওর জন্যে মনোকষ্টকর হলেও ব্যাপারটার গুরুত্ব সেও উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই স্থির করল জুন মাসে একাডেমিক বছরটা কোনোমতে শেষ করে সে দেশে ফিরে আসবে। পরে সম্ভব হলে আবার যাবে। আমার মা-বাবা ও শ্বশুর সবাই এ সিদ্ধান্তে মহাঅখুশি। ডিগ্রি শেষ না করে জ্যোতি ফিরে আসছে এটা সামাজিকভাবে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল তাদের। কিন্তু তবু জ্যোতি ফিরে এলো প্রায় ন’মাস পর।

ইতিমধ্যে একদিন শ্বশুর খবর পেলেন কলকাতায় তার মা গুরুতর অসুস্থ! মাকে দেখতে যাবেন স্থির করলেন তিনি। কিন্তু ভারতীয় হাইকমিশন তাকে কলকাতা যাবার ভিসা দিতে অসম্মতি জানাল। কারণ হিসেবে বলা হলো ফুলব্রাইট প্রফেসর হিসেবে আমেরিকা থাকাকালীন ভারতবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি।

উত্তরে তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার মানেই যদি ভারত বিদ্বেষ হয়, আমি সে দোষে দোষী; কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে আমি কিছু বলিনি।’ বলাবাহুল্য তাকে ভিসা দেওয়া হয়নি। সেদিন সারাক্ষণ তার মনটি বড়ই বিষণ্ণ ছিল। তবু বিকেলে বাসার সামনে তার পাশে পাশে আমিও যখন হাঁটছিলাম তিনি হেসে হেসে বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। আমি এক মা পেয়ে গেছি তো। তাই হয়তো অন্য মাকে আর দেখতে পেলাম না।’

সেবারের অসুখে তার মা মারা যাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাকে আর কোনোদিন দেখতে পাননি। কেননা তার কিছুকাল পরেই তাকেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।

লোকজনের সঙ্গে আমাকে বা জ্যোতিকে আলাপ করিয়ে দেবার সময় অসঙ্কোচে ও বিনা দ্বিধায় তিনি তার পুত্র ও পুত্রবধূ বলে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। এতে মাঝে মাঝে কোনো কোনো ব্যক্তির মধ্যে বাহ্যিক যে প্রতিক্রিয়া হতো যে ধরনের মন্তব্য তারা নির্বিচারে করতেন, তাতে মাঝে মাঝেই আমরা খুব আহত বোধ করতাম। খুবই নিষ্ঠুর মনে হতো তাদের। আর তখনই প্রথম টের পেলাম আমাদের সমাজে তথাকথিত আত্মীয়-অনাত্মীয়ের পার্থক্য কী পরিমাণ গভীর ও জটিল। ঘরে এসে কখনও কখনও কেঁদে ফেলতাম। রাগ করতাম তার উপর। কী দরকার ছিল বাইরের লোকদের কাছে ছেলে-ছেলের বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। তিনি আর আমরা পরস্পরের জন্যে যা-ই উপলব্ধি করি না কেন জগতের কাছে তার কী মূল্য? সবাই জানে তিনি চিরকুমার ও আমরা তার আশ্রিত। কেন তিনি তাহলে অন্য কথা শোনাতে চান তাদের? ব্যাপারটা আমার মধ্যে কী তীব্র প্রতিক্রিয়া করেছে তা প্রথম টের পেলাম সেদিন যেদিন শ্বশুরের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এসেছিলেন আমাদের বাসায়। কথায় কথায় লতায় পাতায় তার সঙ্গে আমার বাপের বাড়ির কোথায় যেন একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক বেরিয়ে পড়ল। তখন আমি এত উত্তেজিত এত আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলাম মুহূর্তের জন্যে যে পরে একথা ভেবে খুবই লজ্জা পেয়েছি। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার কেবল মনে হয়েছে লোককে বলতে পারব তিনি সত্যি সত্যি আমাদের আত্মীয়। পরে আমি বুঝেছি এমন এক পরমাত্মীয়কে নিয়ে একথা ভাবছি, যার সঙ্গে জাগতিকভাবে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাও হাস্যকর।

আজ তার কথা যখন ভাবি, বুঝি জীবনে সুবিচার খুব বেশি পাননি তিনি। একদিকে ভারতীয় হাইকমিশন তাকে তিনি ভারতবিদ্বেষী এই মিথ্যা অভিযোগে। অন্যদিকে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান গোয়েন্দা বিভাগ তাকে অনবরত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে-তার গতিবিধি নজরে রেখেছে। তাকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করে নিয়ে গিয়েছে জেলখানায়। কোনো তথ্য বা প্রমাণ না পেয়ে আবার ছেড়ে দিয়েছে। ১৯৬৫ সালের তার সেই নিদারুণ অভিজ্ঞতা একাধিকবার তিনি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। করেছেন তার দুরবস্থার কথা জানানোর জন্য নয়। সেই সময়টায় জ্যোতির প্রতিক্রিয়া বোঝাবার জন্য। কী রকম ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কেঁদেছিল জ্যোতি জেলখানার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। বলতে বলতে চোখ ছলছল হয়ে উঠত তার। বলতেন, সেদিন তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ছাড়া জ্যোতির আর কেউ নেই।

অবিভক্ত বাংলায় কলকাতাতে পড়াশোনা করেছেন তিনি। দেশভাগের পর আত্মীয়-স্বজনরা সবাই চলে গিয়েছে সেখানে। তিনি একা থেকে গেছেন দেশের মাটি কামড়ে। কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, ছাত্রাবাস বানিয়েছেন, গরিব মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। তার দেশাত্মবোধ এতটা গভীর, এতটা খাঁটি ছিল যে, ১৯৬৪-র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরও হিন্দুদের দেশত্যাগকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। অথচ তার সেই দেশ জীবিত অবস্থায় যেমন, মৃত্যুতে, এমনকি মৃত্যুর পরও তাকে কী মূল্যই না দিল! ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত দয়ালু ও পরোপকারী ছিলেন তিনি। বেশ কিছু ব্যক্তি নিয়মিত অর্থ সাহায্য নিতে আসত তার কাছে। মাঝে মাঝে একটু আধটু বিরক্তি প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের প্রায় কাউকেই খালি হাতে ফেরাতেন না তিনি। ঈশ্বরে ভক্তি ছিল তার অগাধ! কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মের অনুশাসনে বাঁধা ছিলেন না তিনি। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল তার। বাইরের ঘরে টেবিলটি সামনে রেখে চেয়ারের ওপর জোড়াসনে বসে প্রতিদিন সকালে অর্ধ নিমীলিত চোখে তিনি ধ্যান করতেন। সেরকম অবস্থায় তার মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে উচ্চারিত কয়েকটি শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। ‘এ সাহস্য পরমাসম্পদ! এ সাহস্য পরমাগতি।’ আমি আজও তার সেই ধ্যানমগ্ন সৌম্য মুখমণ্ডল, শূন্যে উত্থিত সেই ঈষৎ ঝুলে পড়া চোয়াল স্পষ্ট দেখতে পাই। আধুনিকতায় আমার অনাস্থায় তিনি একটু আধটু আহত হতেন। আমি তাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, ‘সৃষ্টিকর্তা বলতে তুমি কী বোঝ?’ বলতেন, ‘বিশাল এক শক্তি। এক বিরাট জ্যোতি। অসম্ভব বড় এক ক্ষমতা...।’

বলতে বলতে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। দু’হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনি ঈশ্বরকে বর্ণনা করতে চাইতেন আমার কাছে। আমার মাথায় ঢুকত না কিছুই। কিন্তু তিনি বলতেন, ‘এমন একদিন আসতে পারে যেদিন তুমি অসম্ভবরকম ঈশ্বরপ্রেমী হয়ে পড়বে। তোমার মধ্যে সেই জিনিস আমি দেখেছি।’

আজ পর্যন্ত উনি যা যা বলছেন, তার প্রায় সবটাই ফলেছে। ওই একটি মাত্র ব্যাপার ছাড়া। জীবন এখনও শেষ হয়নি। দেখা যাক কী হয়। 

আমি লক্ষ করেছি অনেক লোকের অনেক রকম ভুল ধারণা ছিল দূর থেকে দেখা এই মানুষটিকে ঘিরে। কোনোরকম রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি সাধারণত দিতেন না। রাজনীতির ক্ষেত্রে তেমন সাহসী ভূমিকা তিনি সবসময় গ্রহণ করেননি। সেটা তার চারিত্রিক দুর্বলতা বলে মনে করত লোকে। কিন্তু আমি জানতাম সেটা তার দুর্বলতার কারণ নয়। রাজনৈতিক বিশ্বাসহীনতার জন্যও নয়। তিনি তার অতীত অভিজ্ঞতা ও সামাজিক অবস্থান থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে এসব করে তিনি যা হারাবেন, তা সমাজের জন্য আরও ক্ষতিকর হবে। তাই তিনি নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করে সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করতেন-নৈতিকতার উত্তরণ ঘটাতে চাইতেন। জগন্নাথ হলের তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে সংখ্যালঘু ছাত্রদের প্রাপ্য অধিকার সংরক্ষণ ও স্বার্থ রক্ষার কথা ভাবতেন। শিক্ষকতা ও সৎ কর্মনিষ্ঠা এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করাতেই তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। তবু তার নিন্দুকের অভাব ছিল না। এমনকি তার প্রাণপ্রিয় জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রও তাকে গালাগাল দিত পাকিস্তান সরকারের দালাল বলে।

ব্যক্তিগত জীবনে অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তিনি। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধিতা, দুই সম্প্রদায়ের লোকজনের ভেতরকার সংকীর্ণতা তাকে অত্যন্ত আহত করত। তিনি নিজের কন্যা বলে যাকে জীবনে গ্রহণ করেছিলেন তিনি ছিলেন মুসলমান। প্রাত্যহিক কথাবার্তায় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’, ‘খোদা হাফেজ’, ‘আসসালামুআলাইকুম’, ‘মেহেরবানি’, ‘দোয়া’, ‘দাওয়াত’ ইত্যাদি শব্দ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতেন। ধুতির উপর পরতেন কালো শেরোয়ানি। জানাজার নামাজে সকলের সঙ্গে লাইনে দাঁড়াতেন। হাত তুলে দোয়া মাগতেন।

নিজে কখনও সংসার করেননি। অথচ কী আশ্চর্যরকম বাৎসল্য ছিল তার। আমার অনার্স পরীক্ষার আগে আগে প্রচুর পড়ার চাপ। কিন্তু প্রচণ্ড ঘুমের নেশা। কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারি না। রাত ১০টার দিকে শ্বশুর নিজের হাতে কফি করে খাওয়াতেন আমাকে। কিন্তু কী পোড়া ঘুম ছিল তখন আমার চোখে। কফি খেয়েই আমি আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। উনি জাগাতেন না আমাকে। কখন আলো নিভিয়ে চলে যেতেন। জাগতাম একেবারে সেই ভোরে। জ্যোতি তত দিনে আবার আমেরিকায়। ১৯৬৯-এর সেপ্টেম্বরে চলে গেছে সে। আমার যাবার কথা জানুয়ারিতে। এবার বিদেশ যাওয়া আর ঠেকানো যাবে না।

... ১৯৭০-এর ১৭ জানুয়ারি আমি আমেরিকা রওনা হই। পড়াশোনা করতে ও স্বামীর সঙ্গী হতে। শ্বশুরকে একা ফেলে রেখে। এ ব্যাপারে আমার চেয়েও আমার শ্বশুরের আগ্রহ ছিল বেশি। যদিও বিমানবন্দরে বড়ই কাতর দেখাচ্ছিল তাকে। ১৫ তারিখ রাতে মুন্সীগঞ্জ গিয়েছিলাম বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা করতে। বিয়ের পর মুসীগঞ্জ গিয়ে খুব একটা থাকা হয়নি। শ্বশুর একা থাকবেন বলে মা-বাবাও জোর করেননি থাকার জন্যে। বিদেশ চলে যাব বলে এবার শ্বশুর বার বার বলে দিলেন আমি যেন পরদিনই চলে না আসি। একবারে যাবার দিন সকালে আসতে বললেন। রাতে ফ্লাইট। কোনো তাড়া নেই। অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছি। আমিও ভাবলাম তাই করব। কিন্তু পরদিন দুপুরে বাবা সদ্য বাসায় ফিরেছে কাজ থেকে। আমি হঠাৎ স্থির করলাম তখনই ঢাকা চলে যাব। সবাই একটু অবাক হলো। কিন্তু কেউ বাধা দিল না। মা-ও দিদিসহ আত্মীয় স্বজনের কেউ কেউ এলো আমার সঙ্গে। বাবাকে পরদিন বিমানবন্দরে আসতে বলেছিলাম। আসবেন কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু চোখের সামনে আমাকে বিদায় দিতে পারবেন না বলে শেষ পর্যন্ত বাবা আর পরদিন ঢাকা আসেননি। বাবাকে আর কখনও দেখতে পাইনি আমি। আমার পশ্চাতে তার ক্রন্দনরত মুখখানাই বার বার চোখে ভাসে। স্বদেশের শেষ রাতটি শ্বশুরালয়ে কাটিয়ে শ্বশুরকে একা ফেলে বিদেশে চলে যাবার অপরাধবোধ কিছুটা লাঘব করতে পেরেছিলাম কিনা জানি না।

আমি আমেরিকা যাবার ছ’মাস পরই বাবা মারা যান। অত্যন্ত আকস্মিকভাবে। তার মৃত্যু সংবাদ কাউকে উচ্চারণ করতে হয়নি আমার কাছে। আমি কেমন করে জানি বুঝে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম প্রিয়জনের মৃত্যু তাও আবার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু। এত অকস্মাৎ-এত দূরে-এমন অবস্থায়! আমি প্রায় অর্ধ-উন্মাদ হয়ে পড়েছিলাম। আমার অবস্থা শুনে ঢাকা থেকে ছুটে গিয়েছিলেন শ্বশুর ফিলাডেলফিয়ায়। তিনি তখন না গেলে এবং তার উপস্থিতি ও কথাবার্তা দিয়ে আমাকে সুস্থ ও কর্মক্ষম করে না তুললে আজ আমার কী অবস্থা হতো জানি না। আমি তখন কেবল বলতাম, ‘আমার বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা এতটা গভীর যদি না হতো অথবা তিনি এত বেশি আমাদের জন্য যদি না করতেন কষ্টটা হয়তো সহনীয় হতো। অন্তত এতটা অসহ্য মনে হতো না।’ তিনি আমাকে বোঝাতেন জীবনে প্রথম শোক তাই স্থিরতাবে চিন্তা করতে পারছি না আমি। শোকটা যখন একটু প্রশমিত হয়ে আসবে, আরও শোকের অভিজ্ঞতা যখন হবে, তখন বুঝব সম্পর্কের এই গভীরতা এবং বাবার এতটা উদারতা যা আজ অসহনীয় মনে হচ্ছে-পরবর্তীকালে তা-ই কী রকম শক্তির উৎস ও অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে আমার জন্য। বলতেন, ‘আজ যা তোমাকে অথর্ব ও অকর্মণ্য করে দিচ্ছে কাল তা থেকেই কাজের উৎসাহ পাবে দেখ। যারা তোমার মতো পিতৃস্নেহ পায়নি, শোক তাদের কম হতে পারে বাবার মৃত্যুতে। কিন্তু তাদের মতো দুর্ভাগা কেউ নেই।’ শ্বশুরের কথাগুলোর সত্যতা ২০-২১ বছর পর বুঝতে পারি।

মৃত্যুর পর বাবার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে এই অঙ্গীকারে আমি যখন খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হতে প্রস্তুত এবং সহপাঠী ডেভিডের কথামতো পাদ্রি এসে যখন আমাদের বাসায় উপস্থিত, আমার শ্বশুর ও স্বামী একটুও বিচলিত না হয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা মোকাবিলা করলেন। রাগ না করে, আমাকে কিছু না বলে পাদ্রিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিদায় করেছিলেন তারা। তাদের সব কথা আমি শুনিনি। কিন্তু শ্বশুরের একটা কথা শুনেছিলাম। তিনি পাদ্রিকে বলেছিলেন, ‘আমার পুত্রবধূ এখন সুস্থ নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার নেই। তাকে সময় দিন। পরে সুস্থ হয়ে যদি সে খ্রিষ্টান হতে চায়, আমরা আপত্তি করব না।’

বাবার মৃত্যুর পর পিতৃসংসারের দায়িত্ব পালনের জন্যে একটা পার্ট-টাইম চাকরি নিলাম। মাস শেষে প্রথম যখন হাতে মাইনে পেলাম, অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল আমার বাবার কথা ভেবে। যে কাজ আজ বাধ্য হয়ে দায়িত্ববোধ থেকে করছি, তা যদি কয়েক মাস আগে শুরু করতে পারতাম। কর্তব্যের বাধ্যবাধকতা থাকত না সেখানে। কিন্তু কী নির্মল আনন্দের অভিজ্ঞতা হতে পারত সেটা! আর্থিক দুর্ভাবনায় জর্জরিত অসুস্থ পিতাও হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারতেন তার পাশে কেউ আছে জানলে। আমার অবস্থাটা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন শ্বশুর। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের জীবনের অনুরূপ একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন আমায়। কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশনে থেকে পড়াশোনা করতেন তিনি। বরাবরই খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। তাই বৃত্তি পেতেন। রামকৃষ্ণ মিশনে থাকা, খাওয়া ও পড়াশোনার জন্যে কোনো টাকা-পয়সা লাগত না কোনো ছাত্রের। কিন্তু শর্ত ছিল কেউ কোনো রোজগার করলে বা বৃত্তি পেলে তার সবটাই মিশনকে দিয়ে দিতে হবে। সিলেটে তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। চুরি হওয়ার ভয়ে কোমরে ধুতির খুঁটে জড়িয়ে রাখা বৃত্তির টাকা নিয়ে বাসে করে যখন হোস্টেলে ফিরতেন তিনি বার বার টাকাগুলো স্পর্শ করে দেখতেন ঠিক আছে কিনা, তখন একটা কথা খুব মনে হতো তার। ভাবতেন এ টাকা না পেলেও তো মিশনে থাকতে তার কোনো অসুবিধা হতো না। অথচ এ টাকা সিলেটে বাড়িতে পাঠাতে পারলে কত উপকার হতো তাদের। কিন্তু তবু প্রতি মাসে গুনে গুনে সম্পূর্ণ টাকাটা দিয়ে দিতে হতো মিশনকে।

আমাকে একটু সুস্থ করে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ দেশে ফিরে এলেন তিনি। আর এক মাসের ভেতরে নেমে এলো পঁচিশে মার্চের কালরাত্রি। আমার সঙ্গে জীবনের শেষ কয়েকটা মাস তিনি কাটালেন আমার এমন একটি মানসিক বিপর্যয়ের অবস্থায়, যে ভালো করে তার সঙ্গে বসে দু’দণ্ড কথা পর্যন্ত বলিনি। তার প্রিয় কোনো খাবার তাকে রেঁধে খাওয়াইনি। কত সময় কত ধমক দিয়েছি-রাগ করেছি-কথা শুনিনি। যদি তখন জানতাম, যদি একবারও বুঝতে পারতাম ঠিক আট মাসের মাথায় আমি দ্বিতীয়বার পিতৃহীন হব, তাহলে কি এমন করতে পারতাম?

আজও স্পষ্ট মনে পড়ে ফিলাডেলফিয়া থেকে তার চলে আসার দিনটির কথা। একটিবারের জন্যে আর আগের মতো তাকে থেকে যেতে বললাম না সেদিন। কেমন করে বলব? অবসর গ্রহণের পর ইমেরিটাস প্রফেসর হবেন বড় শখ তার। এতবার ছুটি বাড়ানো হয়েছে, আর বাড়ানো ঠিক নয়। তিনিই এসব কথা বুঝিয়েছিলেন আমাদের। আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছিলেন তিনি সেবার এসে। আরও কয়েকটিতে আমন্ত্রণ ছিল। তবু তিনি ভাইস চ্যান্সেলরকে অসন্তুষ্ট করে আবার ছুটি বাড়াতে চাননি। আমাদের বোঝালেন জগন্নাথ হলের দায়িত্ব অবশেষে তো ছেড়েই দিয়েছেন, যা ছাড়তে বেশ কিছু বছর ধরে জ্যোতি বলছিল তাকে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন পড়াবার কাজটা শেষ হলে তিনি লেখার কাজে মন দেবেন। তার World Brotherhood-এর কাজ শুরু করবেন। ধানমন্ডিতে তার নিজের বাড়িতেই হবে সেই Govinda Dev Foundation For World Brotherhood-এর সেন্টার, আমেরিকায় উইলক্সবেরিতে তার ভক্ত ও ছাত্ররা মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে একদিন যার উদ্বোধন করেছিল। অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন ছিল তার। ভেবেছিলেন তত দিনে আমরা পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরব। একই বাড়িতে উপরে থাকব আমরা তিনজন। নিচে থাকবে কার্যালয়, ফাউন্ডেশনের। কোথায় গেল World Brotherhood, কোথায় গেল সেই বাড়ি। ধানমন্ডির মতো জায়গায় শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের ষোলো কাঠার ওপর সেই বাড়ি আজ ২০ বছর একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বেদখল। তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের কী অপূর্ব নিদর্শন!

১৯৭১-এর ২৭ মার্চ ভোর বেলা কবি নির্মলেন্দু গুণ ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডে গিয়েছিলেন দুই কার্ফুর মাঝখানে। লোকমুখে শোনা দুঃসংবাদটির সত্যতা যাচাই করতে। নিজের চোখে তিনি দেখে এসেছেন মেঝেতে থোকা থোকা রক্ত। ঝুলন্ত টেলিফোনের রিসিভারেও রক্তের দাগ। মানুষের প্রতি অবিচল বিশ্বাসে তিনি কি আশা করেছিলেন কেউ এসে তাকে বাঁচাবে তখনও? কাকে ডেকেছিলেন তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তে? কার কথা তখন মনে পড়েছিল তার?

সেদিন ভোরে টেম্পল ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট টেলিপ্রন্টার চালাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজে বাংলাদেশের যে ভয়ঙ্কর খবর বেরিয়ে এসেছিল জ্যোতির চোখের সামনে, প্রায় একই সময় সমস্ত বিশ্ববাসীও যখন দম বন্ধ করে সেই খবর শোনে, তখন কি সে বা কেউ ভুলেও ভাবতে পেরেছিল এমন সৌম্য, এমন অজাতশত্রু, এমন নির্মল, নিষ্পাপ এই মানুষটিকে কেউ তার ঘরে এসে খুন করে যেতে পারে?

বাবার মতো তার মৃত্যু সংবাদও কাউকে জানাতে হয়নি আমাকে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের ভাসা ভাসা সংবাদ পেয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালিরা সেদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ জানাতে এসেছিলাম। সেখানে সেই প্রতিবাদ মিছিলের এক কোনায় দাঁড়িয়ে দেখলাম দূরে ফারুকুল ইসলাম কথা বলছে জ্যোতির সঙ্গে। হঠাৎ অবিশ্বাস্যভাবে জ্যোতির মুখটা এমন কঠিন এমন কালো হয়ে গেল যে, আমি পরিষ্কার বুঝে গেলাম ২৫-২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে প্রিয়জনকে হারিয়েছি। আর তাই জ্যোতি কাছে এসে যখন আমাকে বলল, ‘চল ফিলাডেলফিয়া ফিরে যাই’ আমি কোনো প্রশ্ন না করে ওকে অনুসরণ করি। মিছিল পেছনে রেখে নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ায় বাসায় যাবার সারাটা পথে আমরা কোনো কথা বলিনি।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে আমি যখন স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলাম, ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের সেই লাল বাড়িটির চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। সেখানে তখন খোলা মাঠ। আমেরিকার মাটিতে ধুতি পরে প্রথম যখন বিমান থেকে নেমেছিলেন তিনি, একজন আমেরিকান (পরে তার অনুরক্ত শিষ্য) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, Are you a Hindu? তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, No, I am a humanist. এরকম উত্তর এদেশের আর কে কোন দেশে গিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন আমি জানি না। শুধু ভাবি স্বাধীন বাংলাদেশে এই হিউম্যানিস্টের বহু স্মৃতি বিজড়িত বাসস্থানখানা এত তাড়াতাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া এতটাই কি জরুরি ছিল? কেন? কার জন্য?

মনে পড়ে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে পড়ি তখন। ১৯৬৫-৬৬ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্সের উল্টোদিকে মেডিক্যাল কলেজের সামনে বাসস্টপ। আজিমপুর হোস্টেলে হেঁটে যেতে যেদিন মন চাইত না আমার, সেদিন সেই বাসস্টপে এসে দাঁড়াতাম। বাসের জন্যে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে সামনের কোনাকুনি রাস্তাটির শেষ প্রান্তে (যেখানে ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের সেই বাড়িটি) তাকিয়ে আমার কেমন যেন মনে হতো পৃথিবী ওখানেই শেষ। এরপর আর কিছু নেই। কেন যে এমন মনে হতো আমি জানি না, হয়তো ঢাকায় আমার বিচরণভূমি অত্যন্ত সীমিত ছিল তাই। হয়তো গাছপালায় একাকার রাস্তার শেষটুকু আর দেখা যেত না সে জন্য। আমি ঠিক বলতে পারব না কেন। কিন্তু কী আশ্চর্য যেখানে পৃথিবী শেষ ভেবেছিলাম, সেখানেই আমার পৃথিবী শুরু হয়েছিল একদিন। আজও সেই রাস্তা অবিকল সেরকম আছে। সেই শিবমন্দির আছে। জগন্নাথ হল, সায়েন্স অ্যানেক্স, মেডিক্যাল কলেজ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সেই বিশাল দালান, সবই আছে। নেই শুধু একটি মানুষ। আর তার অনেক স্মৃতি জড়ানো সেই লাল ইটের দালান, ৫ সেক্রেটারিয়েট রোড। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //