বিজয়ের ৫২

কিছু  সংখ্যা কেবল সংখ্যা নয়; বাঙালির ইতিহাসের একেকটা অধ্যায়ের নাম। তেমনি কিছু  তারিখ কেবল তারিখ নয়, ইতিহাসের একেকটা বাঁকের নাম। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আর একাত্তরের সাতই মার্চ, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর বাঙালির জন্য কেবল সংখ্যা নয়। যেসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেয়েছে, তারই একেকটা দিকচিহ্ন বহন করে তারিখগুলো। এই তারিখগুলোর হাত ধরে এ-বছর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২ বছর আর ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্তি হলো; এই মাইলফলক নিয়ে কোথাও অবশ্য তেমন কোনো উদযাপন নেই। আদতে বাঙালির ত্যাগ ও গৌরব যেমন মিশে আছে সংখ্যা দুটিতে, তেমনি শত শত বছর ধরে শোষিত বাঙালির জেগে ওঠা এবং স্বকীয়তা অর্জনের চেতনার ভিত্তিমূলও প্রোথিত আছে নিরীহ সংখ্যা দুটির মধ্যে। ত্যাগের বিনিময়ে অর্জনের মধ্যে যে মাহাত্ম্য থাকে, তার সঙ্গে তুল্য কিছু  নেই। তাই কেবল একাত্তরেই লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষের যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, তার ৫২ বছর নিঃসন্দেহে আনন্দের, গর্বের। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটা উক্তি আছে, মানুষ পরাজিত হওয়ার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। স্বাভাবিকভাবে সবাই জিততে চায়। কিন্তু সবাই জিততে পারে না। বাঙালি বাহান্নয় এবং একাত্তরে জিতেছিল। সে-জয়ের মধ্য দিয়ে এ-ভূখ-ের বাঙালি কেবল তার সাক্ষাৎ-শত্রুদের পরাজিত করেনি, পরাস্ত করেছিল একটা ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক চেতনাকবলিত দর্শনকে। এভাবেও বলা যায়, ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি কেবল শত্রুদের পরাজিত করে জেতেনি, মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক দর্শনের বিপরীতে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক দর্শন প্রতিষ্ঠার উর্বর ভূমিতে সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রাপ্তিযোগের এসব কথা উচ্চারণ করা যে কোনো বাঙালির জন্যই গর্বের, অহংকারের। সেই কারণে রাষ্ট্রের নানা অর্জন-উদযাপনেও আমরা শামিল হই। তবে প্রাপ্তির পরই কিন্তু আমরা হিসাব মিলাতে চাই; যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল, ততটুকু কি পেয়েছি? কতটা পেয়েছি, কতটা পাইনি? কী কী কারণে কিংবা কোন কোন ঘাটতির কারণে পুরোটা পাইনি। বিজয়ের বাহান্ন বছর পূর্তিতে সেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করা যেতেই পারে। অবশ্য প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার সব সমীকরণ এখানে মেলানো সম্ভব নয়। সাহিত্য-সংস্কৃতির দিক থেকে আমাদের প্রাপ্তি ও সংকটের দিকে ইঙ্গিত-অন্বেষাতে সীমিত থাকবে এ-লেখার গতিপথ।

দুই
২০১৬ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক কথোপকথনে সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, বাংলাদেশ একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।...আমার সেই আশাটা পূরণ হয়নি। আমার তো মনে হয়, পাকিস্তান আমলে আমরা যতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছি।’ বিজয়ের বাহান্ন বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকে কেউ অস্বীকার করে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ রাজনীনৈতিক অসষ্ণুহিতায় সামাজিক অস্বস্তি সত্ত্বেও শিক্ষার হার থেকে শুরু সামাজিক নানা মানদণ্ডে দেশ এগিয়েছে অনেক দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু যে চেতনার সাতচল্লিশে প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জাতিগত-ভাষাগত-সংস্কৃতিগত ঐক্যের মধ্যে মুক্তির নিশানা খুঁজে পেয়েছিল, যে চেতনার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল চেতনার আদর্শকে আঁকড়ে ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের দীক্ষা নিয়েছিল, যে চেতনার ভিত্তিতে অখণ্ড বাংলা সাহিত্য থেকে বিকশিত হলো সাহিত্যের নতুন বিষয় ও ভাষা- যার নাম হলো বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য, যে চেতনার ভিত্তিতে হরফ পরিবর্তনের মতো ষড়যন্ত্র রুখতে পেরেছিল, যে চেতনার প্রবল শক্তিতে রবীন্দ্রসাহিত্য বর্জন নজরুলসাহিত্যের কর্তন বানচাল করতে পেরেছিল, বাঙালি সেই চেতনার পথ ধরে কতটা এগিয়েছে? নাকি থমকে আছে? নাকি পশ্চাদপসরণ ঘটেছে?

বিজয় দিবস উপলক্ষে এই সব প্রশ্ন নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ বিজয় মানে আনন্দ, বিজয় মানে উৎসব, বিজয় মানে বীরত্বগাথার উদযাপন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আলোর নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি আমাদের বিজয়ের পাশেও যে রয়েছে বেদনা কুণ্ঠিত হওয়ার ঘটনা। কারণ ষোলোই ডিসেম্বরের মাত্র দুদিন আগেই আমাদের পালন করতে হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালির প্রগতিশীল চেতনা বিনির্মাণে ছিল যাদের সবচেয়ে বড় অবদান, প্রগতি পরিপন্থী ও মানবতাবিরোধী শক্তি তাদের বাঁচতে দেয়নি। অনেক অভাব পূরণ হলেও তেমন আদর্শবাদী আপসহীন বুদ্ধিজীবী বাঙালি আর পায়নি। সেই শূন্যতা আজও অপূরণীয়।

আমাদের স্মরণে রাখতে হয়, বিজয়ের মাত্র চার বছরের মাথায় আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার সহযোদ্ধাদের এই আমরাই হত্যা করেছি। সুতরাং বিজয়ের আনুষ্ঠানিকতার প্রসঙ্গ এলেই আমাদের সামনে আসে একাত্তরের রক্তনদী, বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের ছিন্নভিন্ন মরদেহ আর পঁচাত্তর শোক-সাগরের চিত্র। বিজয়ের বাহান্নয় এসে আমাদের আত্মসমালোচনা করা দরকার এই কারণে, আমরা কি সত্যিকার অর্থেই একাত্তরের পরজিত অপশক্তিতে রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে, দেশপ্রেম দিয়ে সততা দিয়ে মোকাবিলা করতে পেরেছি? নাকি সেই শক্তি যখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের সাথে আপস করে পথ চলেছি?

বর্তমানে দেশ পরিচালনায় রয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’; কিন্তু কোথাও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার প্রচেষ্টা নেই। ফলে বাড়ছে ধর্মান্ধতা। বাউলদের ওপর হামলায় তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হয়, তা রোধ তো করা যায়ই না; থলের বেড়াল বেরোনোর আশঙ্কায় বেশির ভাগ তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। দৃশ্যত নারীর নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু ধর্মীয় মাহফিলগুলোতে, বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে অবারিতভাবে চলছে নারীবিরোধী বিষোদ্গার, যেন পৃথিবীতে একমাত্র সমস্যা লুকিয়ে রয়েছে নারীর অগ্রগতির মধ্যে। নারী জাগরণের অগ্রপথিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে এখনো শত্রুজ্ঞান করা হয়। কিন্তু তাদের শাস্তি হয় না; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শাস্তি হয় ভিন্নমতাবলম্বীদের।

সাম্প্রদায়িক শক্তির অন্যায্য দাবির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আপসকামী মানসিকতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সুবিধাবাদী চারিত্র্য নতুন প্রজন্মকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা যখন বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন করে, তখন সঠিক উত্তর দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। কারণ ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কত ঘটনাই না ঘটছে! 

বিজয়ের বাহান্নয় আমাদের প্রত্যাশা হোক, মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাগরণ, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পথের বাধা দূরীকরণ, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সুবিধাবাদী চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয়, সর্বোপরি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের বাস্তবায়ন। পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে, তাদের রাষ্ট্র নেই। কারণ তাদের নেতা নেই। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু কেমন দেশ চেয়েছিলেন? বাহাত্তরের সংবিধানের ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’- এই চার মূলনীতির মধ্যেই রয়েছে তার তাৎপর্য। সুতরাং বিজয়ের বাহান্নয় রাষ্ট্র তথা সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, চার মূলনীতির শতভাগ বাস্তবায়ন। সে-পথ মসৃণ নয় মোটেও; কণ্টকাকীর্ণ। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণ নিয়ে বলতেই হয়, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’ 

লেখক: শিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //