তারা ‘কোনোদিন জাগিবে না আর’

পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার ঘটে যেমন সত্য, তেমনি সংহারের মধ্য দিয়ে নিঃশেষ হয় সেই প্রাণ; কিন্তু কিছু প্রাণ কেবলই দিয়ে যান সমাজ, রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি পৃথিবীকে। সেই প্রাণ মহৎ প্রাণ। সেই প্রাণ রেখে যান স্মৃতি, যা কাল পেরিয়ে মহাকাল হৃদয়ে ধরে রাখে। প্রাণবায়ু দান করে জিইয়ে রাখে আপন মহিমায়। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই নশ্বর পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে অসীমে মিলিয়ে গিয়েছেন- এমনই এক মহৎ প্রাণ লেখক, শিক্ষক ও সমাজসেবক সুফিয়া খাতুন। মারা গিয়েছেন গত ৭ জানুয়ারি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে’র জন্য পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। 

স্থপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন মারা গিয়েছেন গত ১ জানুয়ারি। তিনি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ছিলেন। 

বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন গত ৫ অক্টোবর। পেশাগত জীবনে জড়িত ছিলেন শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতায়। পরিচালক ছিলেন বাংলা একাডেমির। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ অধিক খ্যাতি লাভ করেছিল। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক। 

স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ অনেক ভাস্কর্যের শিল্পী শামীম সিকদার মৃত্যুবরণ করেন ২১ মার্চ ঢাকায়। তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মাণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্যও তিনি নির্মাণ করেন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে অর্জন করেন একুশে পদক। শামীম সিকদার ছিলেন তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটের (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৮০ থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ললিতকলা অনুষদের ফ্যাকাল্টি সদস্যও ছিলেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস পুরস্কার অর্জন করেন ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক বুলবুল মহলানবীশ মারা গিয়েছেন গত ১৪ জুলাই। পেশাগত জীবনে ছিলেন শিক্ষক। নজরুল সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশের লেখক, কবি, উপস্থাপক, আবৃত্তি ও নাট্যশিল্পী হিসেবে বেশ সুনাম ছিল। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ কালজয়ী এ গানের কণ্ঠ দেন বুলবুল। ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি ও স্মৃতি ৭১’ তার লেখা বহুল আলোচিত বই। 

শহীদজায়া পান্না কায়সার মৃত্যুবরণ করেন গত ৪ আগস্ট। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণার জন্য ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার। অভিনেত্রী শমী কায়সার ও অমিতাভ কায়সার তার দুই সন্তান। পেশাগত জীবনে পান্না কায়সার ছিলেন শিক্ষক। যুক্ত ছিলেন খেলাঘর, উদীচীসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। তার প্রথম গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে’। আরও গ্রন্থ হলো- ‘মুক্তি’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘হৃদয়ে একাত্তর’, ‘আমি ও আমার মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধ-সমগ্র’, ‘একাত্তরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার’, ‘মুক্তিযুদ্ধের     কথকতা’, ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।

কবি মোহাম্মদ রফিক মৃত্যুবরণ করেছেন গত ৬ আগস্ট। পেশাগত জীবনে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টরের কর্মকর্তা হিসেবে এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে  কাজ করেন। মোহাম্মদ রফিক একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করেছেন।

নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকতউল্লাহ মারা গিয়েছেন গত ২০ সেপ্টেম্বর। নৃত্যচর্চায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে পেয়েছেন একুশে পদক। অভিনয় করতেন। কর্মজীবনে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। একুশে পদক ছাড়াও শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা লাভ করেছেন এ গুণী শিল্পী। ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি ও লোকগীতির স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাদিরা বেগম মারা যান গত ৬ নভেম্বর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার জয়পুরহাটে। সরকারি সঙ্গীত কলেজে ও ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন গত ১১ এপ্রিল। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন ভারতের আগরতলায়। এর পর  সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যে হাসপাতাল থেকে মুক্তিযুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধের পর হাসপাতালটি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে নাম পরিবর্তন করে রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ওষুধনীতি নীতি প্রণয়নের ছিলেন অন্যতম কারিগর। 

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মারা গিয়েছেন গত ৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। তিনি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ইমেরিটাস ফেলো। বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ার‌ম্যান ছিলেন তিনি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতি ও সামাজিক নীতি বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক) মারা গিয়েছেন গত ১৫ মে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করেন এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’র মাধ্যমে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে অভিনয়ের জন্য লাভ করেন শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত তিনি। ফারুক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে সারেং বৌ, লাঠিয়াল, সুজন সখী, নয়নমণি, মিয়াভাই, গোলাপী এখন ট্রেনে, সাহেব, আলোর মিছিল, দিন যায় কথা থাকে ইত্যাদি। 

মিতা চৌধুরী অভিনেত্রী ছিলেন। মারা গিয়েছেন গত ২৯ জুন। অসংখ্য টেলিভিশন নাটক ও থিয়েটার নাটকে কাজ করেছেন তিনি। তার প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘শান্ত কুটির’। বরফ গলা নদী, ডলস হাউসসহ বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। বিটিভিতে মিতা চৌধুরীর প্রথম নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর ‘আরেকটি শহর চাই’। 

সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী ছিলেন কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার ও লেখক। মারা যান ১৮ সেপ্টেম্বর। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।

আবদুল মতিন চৌধুরী ছিলেন ভাষাসৈনিক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ। মৃতুবরণ করেন ৪ নভেম্বর। 

২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল মারা গিয়েছেন রণজিৎ গুহ। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার একজন বাঙালি ভারতীয় ইতিহাসবিদ, যিনি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। 

বাংলাদেশি সাবেক সচিব, কবি, সাহিত্যিক, উপন্যাসিক, সুরকার ও গীতিকার আজিজুর রহমান আজিজ মারা গিয়েছেন গত ১০ অক্টোবর।

ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ আব্দুল গনি আজহারী মারা গিয়েছেন ১৯ জানুয়ারি। তিনি কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দ, মাজাহির উলুম সাহারানপুর ও আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন তিনি।

কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী কল্যাণী কাজী মৃত্যুবরণ করেন ১২ মে। তিনি নজরুলগীতির গায়িকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

ভাষাসৈনিক ও লেখিকা খালেদা মনযূর-এ-খুদা (খালেদা ফেন্সি খানম) মারা গিয়েছেন গত ২৫ মার্চ। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘ভাষা আন্দোলনে’ একুশে পদকে ভূষিত করেন।

ভারতীয় গায়ক-গীতিকার, গিটারবাদক এবং সঙ্গীতজ্ঞ তাপস বাপি দাস পরলোক গমন করেন গত ২৫ জুন। তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বাংলা রক ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।

কলকাতাভিত্তিক ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রধান ও হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রবীর ঘোষ পরলোক গমন করেছেন গত ৭ এপ্রিল। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।

মলয় রায়চৌধুরী একাধারে  কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী এবং বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক। মারা গিয়েছেন গত ২৬ অক্টোবর। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। 

ভারতীয় বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় পরলোক গমন করেছেন গত ৩ মার্চ। তার সৃষ্ট জনপ্রিয়তম গোয়েন্দাকাহিনি পা-ব গোয়েন্দা সিরিজ। 

সম্পাদক, অনুবাদক, লেখক ও পত্রিকা সংগ্রাহক সন্দীপ দত্ত ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন গত ১৫ মার্চ। 

ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার মারা গিয়েছেন গত ৮ মে। তিনি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষসহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা। তিনি আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

প্রথাবিরোধী বাংলা ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সুবিমল মিশ্র পরলোক গমন করেছেন গত ৮ ফেব্রুয়ারি। তিনি মতাদর্শগত কারণে তার দীর্ঘ অর্ধশতকের সাহিত্যজীবনে কখনো বড় পত্রিকায় লেখেননি।

ভারতীয় বাঙালি গায়িকা সুমিত্রা সেন মারা গিয়েছেন গত ৩ জানুয়ারি। তিনি নজরুলগীতি, পল্লীগীতি ও বাংলা আধুনিক গানের শিল্পী হলেও রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী হিসাবে বেশি পরিচিত ছিলেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //