আঁকিয়ে আনিসুল হক

স্বনামখ্যাত সাংবাদিক, কবি ও ঔপন্যাসিক আনিসুল হকের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী হলো ঢাকার উত্তরায় গ্যালারি কায়ায়। ছেলেবেলায় ছবি আঁকতেন, পুঁইশাকের বিচি থেকে বেগুনি রঙ, হলুদরঙা ফুল থেকে হলুদ এসব ছিল ছোটবেলার ছবি আঁকার রঙ! ২০১৬ সাল থেকে প্রায় নিয়মিত আঁকছেন, অবয়বপত্রে তার চিত্রকর্ম দেখছি অনেক দিন থেকেই। এবার গ্যালারিতে সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি! আশির দশকের শেষদিকে নবীন আনিসুল হক বুয়েটের শিক্ষার্থী, কবিতা লিখছেন। মানুষ জাগবে ফের, জাগবে মানুষএমন জাগরণের কবিতা লিখে তখনই তার নাম হয়েছে! তরুণ আবৃত্তিকার হাসান আরিফ, নবীন আবৃত্তিকার আহকামউল্লাহ নানা মঞ্চে এই কবিতা আবৃত্তি করে দর্শকের বাহবা পাচ্ছেন। সেই সময়, সেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকালে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী মেধাবী আনিসুল হক মিটুনের সঙ্গে সে সময় আমাদের পরিচয়। 

তারপর কতকাল কেটে গেল নব্বইয়ের দশকে আনিসুল হক প্রকৌশলীর সরকারি চাকরি পেয়ে ছেড়ে দিয়ে সংবাদপত্রেই থিতু হলেন। এরপর আনিসুল হক সাংবাদিকতা ও কবিতার পাশাপাশি দুই হাতে লিখে পাঠকপ্রিয় একজন লেখক হয়ে উঠলেন। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদকে নিয়ে তার লেখা ‘মা’ অসামান্য মর্মস্পর্শী এক উপন্যাস, পাঠক মহলে সুনাম কুড়িয়েছে। 

নামি লেখক ও কবিদের ছবি আঁকা-আঁকির অনেক ইতিহাস আছে। ৬৩ বছর বয়সে এসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি আঁকতে শুরু করেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধে নিহত কবি গার্সিয়া লোরকা ছবি আঁকতেন, ওপার বাংলার লেখক-চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ও পূর্ণেন্দু পত্রী অসাধারণ ছবি আঁকতেন। বাংলাদেশের কবি সৈয়দ শামসুল হক, লেখক বুলবন ওসমান, হুমায়ূন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে ঢাকায় প্রদর্শনী হয়েছে। এ তালিকায় এবার যুক্ত হলেন আনিসুল হক। ঢাকার বিভিন্ন চিত্রশালায় আয়োজিত চারুশিল্প প্রদর্শনীর একজন নিষ্ঠাবান ও সমঝদার দর্শকও তিনি। ধানমন্ডিতে তার বাড়ির কাছেই আরশীনগর অর্থাৎ গ্যালারি চিত্রক। সময় পেলে সেখানে চলে আসেন, শিল্পীদের কাজ দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এরপর আঁকিয়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অবয়বপত্রে আনিসুল হকের আঁকা ছবি দেখছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। এরপর এককের এই আয়োজন। 

গত ২৬ জানুয়ারি, শুক্রবার সন্ধ্যায় বন্ধুশিল্পী অশোক কর্মকার সহযোগে কায়ায় হাজির হলাম। ঢাকার উত্তরায় সেক্টর ৪-এর সড়ক ১৬-র ২০ সংখ্যক বাড়িতে অবস্থিত স্বনামধন্য গ্যালারি কায়া। দেখি সুধী সমাবেশে আনিস বলছেন তার ছবি আঁকা নিয়ে কয়েকটি কথা। গ্যালারি কায়ার স্বত্বাধিকারী গৌতম চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় এরপর একে একে কথা বললেনঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান ও কবি নির্মলেন্দু গুণ।

পুরো গ্যালারিজুড়ে সাজিয়ে রাখা ছবি দেখে বোঝার চেষ্টা করি লেখক-কবি আঁকিয়ে আনিসের মনোজগতের আলোড়নগুলো। লক্ষ্য করি তার আঁকার প্রধান দুটি প্রবণতা। এক. কৃতী মানুষদের প্রতিকৃতি অঙ্কন, পাশাপাশি শিশু ও নারীর অবয়বে তার অন্তর্গত অনুভবকে খুঁজে দেখার চেষ্টা এবং দুই. বাংলাদেশের প্রকৃতির সৌন্দর্য, গ্রাম ও নগরজীবনের দেখা অদেখা নানা বিষয় নিয়ে সহজভাবে আঁকার প্রয়াস।

প্রতিকৃতি সবচেয়ে বেশি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথের। এ এক অনিবার্য প্রতিকৃতি! 

সন্ন্যাসীর ন্যায় শ্মশ্রুমণ্ডিত রবির ছবি আঁকেননি এমন বাঙালি শিল্পী ও শিক্ষার্থী বিরল! আনিসুল হকের আঁকায় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত মধ্যবয়সী থেকে বৃদ্ধ বয়সের। কবিগুরুর হাতের লেখার আবহে বর্ষীয়ান রবির চিন্তাধ্যানমগ্ন মুখাবয়বের উপস্থাপন কবি-শিল্পীর চমৎকার এক সৃজন! কালচে রেখাঙ্কনে কবির আত্মপ্রতিকৃতির অনুসরণে আরেকটি রবীন্দ্রনাথ তার ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। 

রূপসী বাংলার রূপতাপস কবিদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের একটা মাত্র প্রতিকৃতিই আমরা বেশি দেখিসেই একটিকে নানাভাবে আনিস এঁকেছেন ভালোবেসে, সযতেœ, গভীর মমতায়- কখনো রঙে, কখনো বা সাদা-কালোয়! আবার আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের তরুণ অবয়বে শিল্পীর আগ্রহের প্রতিফলন দেখা গেল। বোধ করি এই সময়টা তার সৃজনকাল- সেটিকেই চিত্রপটে ধারণ করেছেন তিনি। 

আনিস এঁকেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, বিপ্লবী চে গুয়েভারা, কবি সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, জাহানারা ইমাম, হুমায়ূন আহমেদ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমি ইমাম, আনিসুল হকের স্ত্রী মেরিনা ইয়াসমিন, চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রতিকৃতি। এঁকেছেন একাধিক আত্মপ্রতিকৃতিও। অঙ্কন ও বর্ণপ্রয়োগের টেকনিকে কিছু সমস্যা থাকলেও আমি অবাক হয়েছি তার অবয়ব মেলানোর ক্ষমতা দেখে! পর্যবেক্ষণের শানিত চোখ তার এই অসামান্য ক্ষমতার উৎস হয়েছে। যেমন তার লেখনীতে স্বাদু বর্ণনায় আমরা নানারকম ছবি পাই গল্পবলার সাবলীল ভঙ্গিতে! আনিসুল হক আরও এঁকেছেন জড়জীবন, আঙিনার ফুলশোভিত বাগান, বৃষ্টিধূসরতায় অস্পষ্ট নগরের স্থাপত্যের শিল্পিত সৌন্দর্য, রিকশা ও রিকশা চালক, নদী ও নৌকার ছবি। এগুলো পেশাদার চারুশিল্পীদের আঁকার প্রিয় বিষয়।

আনিস এঁকেছেন প্রধানত কাগজে জলরঙে, কাগজে অ্যাক্রিলিক রঙেও কতক কাজ করেছেন। কয়েকটি ক্যানভাসেও এঁকেছেন তিনি। রঙ প্রয়োগের ধরন দেখে মনে হয়, তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেই দর্শক-বোদ্ধার সামনে দাঁড়িয়েছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //