রবীন্দ্রনাথের বাঙালিত্ব এবং বৈশাখ

রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কৃতিত্ব হচ্ছে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেক বাঙালির হৃদয় তিনি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে তাকে প্রতিদিনই স্মরণে রাখতে হয়; অবলীলায় চলে আসেন মনে, হৃদয়ের কোণে ক্ষণে ক্ষণে নাড়া দেয় তার গান, কবিতা। গল্প, উপন্যাস, নাটক বা গীতিনাট্যের বিশেষ কোনো শব্দ, বাক্য বা অংশ প্রাত্যহিক জীবনেও বাস্তবতার নিরিখে স্মর্তব্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রসংগীতের আবেগময় শক্তি ও সৌন্দর্যের আকর্ষণ বাঙালি সমাজে ধ্রুবসত্য।

মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে লেখা হয়, ‘বাংলায় এমন কোনো শিক্ষিত গৃহ নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বা অন্ততপক্ষে গাওয়ার চেষ্টা করা হয় না... এমনকি অশিক্ষিত গ্রামবাসীরাও তার গান গেয়ে থাকেন।’

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বাঙালিত্বের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের একান্ত ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। তার স্বভাব ও ঝোঁক বাঙালিত্বের মাধ্যমেই অনিবার্য, স্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত এবং একই প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ঋতুর বৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাপক উপভোগ করেছেন। ব্যক্ত করেছেন নানা ব্যঞ্জনায়। বাংলা প্রতিটি মাসই তিনি নিপুণ উপস্থাপন প্রকৌশলে তুলে ধরেছেন অনন্য অসাধারণত্বে, বিশেষ দর্শন বা উদ্দেশ্য সাধনে। বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্য বাউল, জারি-সারি, কীর্তন চিরকাল ধরে হাটে-মাঠে-ঘাটে প্রচল থাকলেও রবিঠাকুরের আবির্ভাবের পর বৈশাখ আলাদা স্বর, সুর ও মাত্রা পায়।

বৈশাখেই তার জন্মতিথি। ১২৬৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ। হয়তোবা এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে তুলে ধরেছেন অন্যান্য ঋতু থেকে আলাদা করে। নববর্ষকে কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছিলেন। পৃথিবীর সব মানুষকে নিজের আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করার তার ঔদার্য ছিল। তিনি সবার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং বলতেও পেরেছিলেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখ নিয়ে যেমন অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন, তেমনি গানে, এমনকি তার অন্যান্য রচনায়ও এ মাসটি উল্লিখিত হয়েছে বিশেষ প্রেক্ষাপটে, নানা আঙ্গিকে। তিনি সব সময় বৈশাখের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুধাবনের পাশাপাশি দেখেছেন প্রকৃতির বিষণ্ণ, রুদ্ররূপ। আর তা কখনো বয়ে এনেছে বিশেষ বার্তা, তেমনি কখনো ধরা দিয়েছে বিশেষ প্রতীক হয়ে। প্রকৃতির নিখুঁত বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। কল্পনা কাব্যগ্রন্থের ‘বৈশাখ’ কবিতা স্মরণে নেওয়া যেতে পারে।

কবি লিখেছেন, ‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,/ ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,/তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল/কারে দাও ডাক-/হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!’ তিনি বৈশাখের শুষ্ক-রুক্ষ, রুদ্রমূর্তি এমন এক চিত্রকল্পনায় উপস্থাপন করেছেন, প্রকৃতার্থে বৈশাখ এমনই; পৃথিবীবাসী জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছে। কবি এই সংকট থেকে মুক্তির তাড়না অনুভব করেছেন, ‘ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!/ভাঙিয়া মধ্যাহ্নতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে,/চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে/নিস্তব্ধ নির্বাক-/হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!’ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //