Someone’s mouth said, ‘Paint them all
red’/Liar!/Killer!/Demon!
—Holy Mountains by System of a Down
ভাষা পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। সেই ভাষা যখন বিদ্রোহের সুর পায়, ক্ষমতাকে নাড়িয়ে দিতে পারে মুহূর্তেই। মানুষ সহজেই গানের কাছে পৌঁছাতে পারে। এমনকি সহজ একটি গানও হয়ে উঠতে পারে উঁচু তলা থেকে আপামরের কথার অনুষঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ। শিল্পের অন্যান্য শাখার চেয়ে এখানেই গানের ভিন্নতা ও গ্রহণযোগ্যতা। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘বিদ্রোহী’, কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম ‘এসব জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ বা পাবলো পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’র মতোন কিছু কালজয়ী শিল্পকর্ম বাদ দিলে কবিতা বা চিত্রকর্ম কখনো খুব বেশি গণমানুষের হয়ে উঠতে পারেনি, বা দেখাতে পারেনি প্রতিবাদ-বিদ্রোহ। এসবও যে সবাই নিতে পেরেছেন এমন নয়। তবে গানের কথা আলাদা করেই বলতে হবে। প্রয়াত রাজীব আশরাফের লেখা অর্ণবের কণ্ঠে ‘হোক কলরব ফুলগুলো সব/লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান’ গানটি এখন হয়ে উঠেছে তারুণ্যের প্রতিবাদের অন্যতম কণ্ঠস্বর। সে বাংলাদেশ হোক বা পশ্চিমবঙ্গে।
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা স্লোগানের পাশাপাশি নিজেদের অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন গান গেয়ে। নিজেরাও রাজপথে অনেক গান বানিয়ে গেয়েছেন। সেই গান তারুণ্যের, প্রতিবাদের, বিদ্রোহের। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের। সামাজিক মাধ্যমে কবিতা পোস্ট করে, গ্রাফিতি এঁকে, পথনাটক করে তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানান চিত্রশিল্পী, কবি, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতারাও। প্রতিবাদের উদাহরণ হিসেবে ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের একটি গানের কথা উল্লেখ করা যাক, ‘ন্যায্য কথা কইতে গেলে ডাকলে রাজাকার/জাগলো পুরো বাংলাদেশ সামলাও এবার।’ সায়ানের গানে অবশ্য আগে থেকে বিদ্রোহের বিস্ফোরক ভাষা পাওয়া যায়। ক্ষমতাবানদের কটাক্ষ করে তার ‘কী করেছে তোমার বাবা কী করেছে স্বামী’ বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। আমাদের বুদ্ধিজীবী ও নন্দনজীবী সমাজে মাঝেমধ্যে ‘শিল্পের জন্য জীবন নাকি জীবনের জন্য শিল্প’ এ নিয়ে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ হয়। বিদ্রোহের গান মূলত উঠে আসে ‘জীবনের জন্য শিল্প’ থেকে। এমন নয় যে সেসব গানে শিল্প অনুপস্থিত। যে গানে কথা ওড়ে, সুর ঢেউ তোলে-‘বাগ্দেবী’ সেখানে অনুপস্থিত না হয়ে পারেন!
তবে কখনো কখনো খুব সাধারণ বিদ্রোহের গানও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি বিপ্লব-আন্দোলনপরবর্তী রাষ্ট্র-সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান হয়েছে। কোনো জাতীয় দিবসের সকালে সেসব কালজয়ী গানের সুর এখনো আমাদের শিহরিত করে, নাড়া দেয়। ওসব গানে প্রতিবাদ আছে, প্রতিরোধ আছে। এখনো কোনো আন্দোলন, গণজোয়ারের সময় শোনা যায়, ‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে/অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে/রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে।’
গান কখন দ্রোহের কথা বলে? হয়ে ওঠে লাখো মানুষের স্বর? সেই প্রশ্নটাও জরুরি। প্রতিবাদের গান মূলত একপ্রকার বার্তা। সেই বার্তা হতে পারে ভঙ্গুর সমাজ বা রাষ্ট্র মেরামতের। শত বছরের হাজারো বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। সেই গানে মিশে থাকে খেটে খাওয়া মুটে, মজুর, শ্রমিকদের খেদ, ক্ষোভ, ধিক্কার এবং নতুনভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুর। বছর দেড়শ আগে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় সুবিধাবঞ্চিত আফ্রো-আমেরিকানরা কয়লাখনি ও মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কথা বলতে বলতে জন্ম দিয়েছিলেন ব্লুজ। সেই রক্তাক্ত ব্লুজ থেকে পরে সৃষ্টি হয়েছে পুরো পৃথিবীর জ্যাজ, রক, পপ। এসব গানের জনরায় মিলেমিশে মানুষের রক্ত, ঘাম আর দ্রোহের সুর। দ্রোহের ভাষা রয়েছে র্যাগাতেও। বব মার্লে এই কারণে আইকন হয়ে আছেন বিপ্লবের। তার গান এখনো প্রেমের পাশাপাশি নিপীড়িত মানুষের কথা বলে। বর্তমান সময়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরতে র্যাপ আরও বেশি জোরালো ভূমিকা রাখছে। র্যাপারদের জীবনযাত্রা, পোশাক, উপস্থাপন-আরও বেশি আগ্রহ জাগানিয়া। র্যাপে খুব বেশি সুরের বৈচিত্র্য নেই বটে। তবে তার ভাষা তীক্ষ্ণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শেজানের ‘কথা ক’ বেশ আলোচিত হয়েছে। সেই গানের মুখটা এখানে তুলে দিলাম, ‘৫২-তে আর ’২৪-এ তফাত কইরে কই রে? কথা ক!/দ্যাশটা বোলে স্বাধীন, তাইলে খ্যাচটা কই রে? কথা ক!/আমার ভাই-বইন মরে রাস্তায়, তবে চেষ্টা কই রে, কথা ক!/কালসাপ ধরছে গলা পেঁচায়, বাইর কর সাপের মাথা কো?’
প্রতিবাদী গানের জেল হাজতের ঘটনা কম ঘটেনি অতীতে। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না। ‘আওয়াজ উডা’ গানের র্যাপার হান্নান হোসেন শিমুলকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। সেই আলোচিত র্যাপেরও কয়েক কলি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না, ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ আওয়াজ উডা বাংলাদেশ/রাস্তায় এত রক্ত কাগো আওয়াজ উডা/আওয়াজ উডা বাংলাদেশ আওয়াজ উডা বাংলাদেশ/রাস্তায় গুল্লি করলো কেডা/আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’।
ইথুন বাবুর লেখা ও সুরে ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ সবার মুখে মুখে ছিল। তাছাড়া তরুণ কণ্ঠশিল্পী পরশার ‘চলো ভুলে যাই’ গানটিও তরুন কণ্ঠশিল্পী গানটিকেও মানুষ গ্রহণ করেছে সত্যের অমোঘ উচ্চারণ ও স্যাটায়ারের জায়গা থেকে। এই সব গান সময়ের দলিল। হয়তো আবারও কোনো আন্দোলনের সময় এসব গান বিদ্রোহের দামামা বাজাবে রাজপথে। তার সঙ্গে তৈরি হবে নতুন গান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও শিল্পীরা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে গেয়েছিলেন অসংখ্য গান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত সেসব গান আজও মানুষকে শক্তি জোগায়। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, নয়ীম গহরের লেখা ‘নোঙর তোলো তোলো’ কিংবা গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’-যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ভেসে বেড়াবে ইথারে ইথারে। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও কি প্রতিবাদ নেই? বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তিনিও গান লিখেছিলেন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সময় প্রেমিক, পূজারির বাইরে এক বিদ্রোহী রবি ঠাকুরের খোঁজ পাওয়া যায়। সেটি অবশ্য গানের চেয়ে তার কথাসাহিত্যেই বেশি উপস্থিত।
বাংলায় বিদ্রোহের গানের সমার্থক বলা যায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে। ‘বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না’র মতো অবিস্মরণীয় গান গেয়েছেন তিনি, যা বামধারার রাজনীতিবিদদের স্লোগানও হয়ে উঠেছিল। কফিল আহমেদের কণ্ঠস্বরও দ্রোহ ও গণজাগরণের ডাক দেয়। জেমস কি ‘এসো চুল খুলে পথে নামি’ বলে রাস্তায় নামার ডাক দেয় না?
আর্মেনিয়ায় গণহত্যা নিয়ে রকব্যান্ড ‘সিস্টেম অব আ ডাউন’ আজও কথা বলে যাচ্ছে গানে গানে। পিংক ফ্লয়েডের ‘মাদার’, দ্য ক্রানবেরিসের ‘জোম্বি’ ক্ষমতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে বড় কাউন্টার হয়ে আছে। যে ভাষার হোক, দুনিয়া জুড়ে আন্দোলনের ভাষা যেমন এক, তেমনি দ্রোহের গানও।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বিদ্রোহ গানে গানে উপল বড়ুয়া সাহিত্য
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh