ফিওদর দস্তয়েভস্কি : মনোবিশ্লেষণের মহানায়ক

‘মানুষ একটা রহস্য। এর জট খোলা জরুরি। তুমি যদি তোমার পুরোটা জীবন এই জট খোলার পেছনে খরচ করে ফেল, তবে এ কথা বলো না যে তুমি সময় নষ্ট করেছ। আমি সে রহস্য পাঠ করছি, কারণ আমি একজন মানুষ হতে চাই।’

কথাগুলো বলেছিলেন বিশ্বের সাহিত্য জগতের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম একজন, ফিওদর দস্তয়েভস্কি। তার লেখা ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাযোভ’, ‘দি ইডিয়ট’, ‘দ্য গ্যাম্বলার’, ‘দি অ্যাডোলসেন্ট’ ‘হিউমিলিয়েটেড অ্যান্ড ইনসাল্টেড’ বিশ্বখ্যাত সব ক্ল্যাসিক উপন্যাস। সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ, তাবৎ বিষয় বিধৃত হয়েছে তার কথাশিল্পে। যেসব দার্শনিক সত্তা তার উপন্যাসকে করেছে গতিশীল এবং চিন্তাধারাকে করেছে শাণিত। যার কারণে উপন্যাসের শিল্পরূপ হয়েছে সমৃদ্ধতর। মানুষ নিয়েই ছিল তার চর্চা। নানাভাবে, নানা দিক দিয়ে তিনি পাঠ করেছেন মানুষকে। তাই তার লেখায় কখনো ফুটে উঠেছে মানুষের কুটিলতম, তমসাচ্ছন্ন দিক, কখনো আবার ঝলমলে প্রশংসা। মানুষ নিয়ে তার উভয়মুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় ‘ব্রাদার্স কারমায়োভ’ উপন্যাসের এই উক্তিটি দ্বারা, ‘পুরো মানবজাতিকে আমি যত বেশি ভালোবাসি, ব্যক্তি মানুষকে আমি ততই কম ভালোবাসি।’ কিন্তু সর্বোপরি মানুষের চিরন্তন সম্ভাবনায় তিনি বিশ্বাস রাখতেন। তাই মানুষকে নিয়ে তার দৃঢ় আশাবাদই ব্যক্ত হয়েছে তার রচনাগুলোতে। ফিওদর দস্তয়েভস্কি ১৮২১ সালের ১১ নভেম্বর মস্কো শহরের এক অভিজাত অঞ্চল মেরিয়ন রোস্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে মারা যান মাত্র ৫৯ বছরে। 

পিতা ছিলেন একজন সামরিক চিকিৎসক। তার শৃঙ্খলাবদ্ধ ও কঠোর আচরণের জন্য তিনি সবার দৃষ্টি কাড়েন।  

ফিওদর দস্তয়েভস্কি শৈশবে মস্কোর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে ইনস্টিটিউট অব মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার্সে যোগ দেন এবং ১৮৪৩ সালে তিনি প্রকৌশলী ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি কিছু সময় সামরিক প্রকৌশলী হিসেবেও কাজ করেন। সামরিক ক্যাডেট কোরে কর্মরত থেকেও মন ছুঁয়েছিল সাহিত্য রচনায়। ফলে তিনি বিভিন্ন সাহিত্যিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সামরিক প্রকৌশলী  থেকে একজন সাহিত্যিক হয়ে ওঠার এই দীর্ঘ অভিযাত্রা দস্তয়েভস্কির জীবনে এক বিরল অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ন। তার স্থিতপ্রজ্ঞ জ্ঞানধারায় ভিজেছিল কঠোর অনুশীলন অধ্যবসায়ে। ফলে গড়ে ওঠে তার বিশাল শিল্পসাম্রাজ্য। প্রথম উপন্যাস পুয়র ফোক এবং দ্য ডাবল প্রকাশিত হয় ১৮৪৬ সালে।  তার এসব রচনায় দস্তেয়ভস্কি মানবতার অন্তর্দৃষ্টি এবং রুশ সমাজের প্রতিফলন তুলে ধরেন। এই উপন্যাস দুটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যাঙ্গনে যে দাগরেখা অঙ্কন করেন তা ছিল শেষ পর্যন্ত।

বহুমুখী অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল দস্তয়েভস্কির জীবন। ১৮৪৯ সালে, তিনি গোপন রাজনৈতিক সংগঠন ‘পেত্রাশেভস্কি সার্কেল’-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। এই সংগঠনটি জারশাসিত রাশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য প্রচারণা চালাত। শুধু তা-ই না, এটি তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটি রূপ হিসেবেও বিবেচিত। দস্তয়েভস্কির বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয় এবং জার নিকোলাস প্রথমে শাসন কর্তৃপক্ষ তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।

জার শাসনামলে ১৮৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর, দস্তয়েভস্কিকে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য সামরিক প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে আসা হয়। তবে  মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের শেষ মুহূর্তে জার নিকোলাস প্রথম এই শাস্তি রহিত করেন এবং দস্তয়েভস্কিকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনের আদেশ  দেন। এই মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তির ঘটনা দস্তয়েভস্কির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে বিশেষ করে তার সাহিত্যকর্মেও প্রতিফলিত হয়। এ বিষয়ে ফরাসি দার্শনিক ও লেখক আলবার্ট ক্যামু বলেছিলেন : ‘মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা দস্তয়েভস্কিকে জীবনের অসারতাকে নতুন তীব্রতার সঙ্গে চিত্রিত করার ক্ষমতা দেয়। তার চরিত্রগুলো এমনভাবে অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াই করে, যা শুধু টিকে থাকার চেয়ে আরো অনেক কিছু নির্দেশ করে।’ ফিওদর দস্তয়েভস্কি ছিলেন এক স্বর্ণপ্রজ, যিনি মানুষের আত্মার গভীরে প্রবেশ করে তার বেদনাবোধ, অন্ধকার এবং অস্তিত্বের সংকটকে উন্মোচন করেছিলেন। প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সংকট এবং প্রতিটি দ্বিধা তার লেখার অপূর্ব শিল্পপাতা। দস্তয়েভস্কির সৃষ্ট চরিত্রগুলো আমাদের বুঝতে শিখায় যে ব্যথা, অনুশোচনা এবং আত্মান্বেষণই জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য অপরিহার্য। দস্তয়েভস্কি সেই মহান স্বর্ণপ্রজ, যার সাহিত্যে মানব আত্মার অনির্বাণ আলো, ব্যথিত বেদনার অমোঘ ছায়ায় আকাশ হয়ে গেছে। মানব অস্তিত্বে এবং শিল্প-চেতনার গভীরে  সে আকাশ চিরস্থায়ী ছাপ রেখে সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রের মতো আজও জ্বলজ্বল, চিরন্তন হয়ে আছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh