অজান্তা’পা বাড়ি ফিরলেন ঘোর বৃষ্টি মাথায়। ওনার উপরের ঠোঁটের ডান পাশ ও কপালে কালসিটে দাগ। নিচের ঠোঁটের ফাটা অংশের লাল রংটা বৃষ্টি ধোয়ায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। সিল্কি চুল নেতিয়ে আছে। চোখের নিচে গিরিখাদের মতো কালো। ওনার হাতে অসংখ্য কাটা দাগ।
বোধ হয় কাচের চুড়ি ভেঙে যাবার সময় এমন দাগ রেখে গেছে। দরজা খুলে মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তার আতঙ্কিত কণ্ঠে আমি আর শাহরিয়ার পড়ার টেবিল রেখে ছুটে এলাম। আমার তখন তেরো, শাহরিয়ারের এগারো। অজন্তা’পা দাঁড়ানো থেকে মেঝেতে দ্রিম করে পড়ে গেলেন। পড়েই তিনি ছটফট করতে লাগলেন। তার লালা বেরোতে লাগল। কিছুক্ষণ পর লালার সঙ্গে রক্ত। মা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে ফোন করতে বললেন। তিনি শহরে থাকতেন। মা অজন্তা’পার ভেজা কাপড় বদলে বিছানায় শোয়ালেন। তার ঠোঁট তখন নীল। মা সাবুদানা রেঁধে এনে তাকে খাওয়াতে চাইলেন। দুই চুমুক খেয়ে আপা ছটফট শুরু করলেন। আবার তার লালার সঙ্গে রক্ত বেরোতে লাগল। মা ভীত হরিণীর মতো এদিক-ওদিক কিছু যেন খুঁজলেন। তারপর গামছা এনে সেসব মুছতে মুছতে ঢুকরে উঠে বললেন, তোর চাচিকে ডেকে আন। অজন্তা’পার বর অরিন্দম ভাই খুবই রাগি মানুষ। ক’বার আমার সামনেও আপাকে চড়-থাপ্পড় দিয়েছেন। এখন কী করেছেন কে জানে।
চাচি আপার হাত, পা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাপড় গরম করে সেক দিচ্ছেন। মা হাতে-পায়ে তেল মালিশ করছেন। ঘরে কিছু ফল ছিল সেসব মায়ের আদেশে খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। শাহরিয়ার তখন অনেক ছোট। ও ফ্যালফ্যাল করে সবাইকে দেখছে। মা বারবার আপার কপালে চুমু খাচ্ছেন। একসময় মায়ের আদেশে আমি আর শাহরিয়ার ভিজে ভিজে ডাক্তার নিয়ে এলাম। গভীর রাতে বৃষ্টি কমে এলো। বাবা এলেন। বাবাকে দেখে মা খণ্ডিত হলেন। বাড়িটায় কম্পন তুলে কাঁদলেন। আমরা থরথর করে কাঁপছিলাম। বাবার সাড়া পেয়ে অজন্তা’পা আবার ছটফট করতে লাগলেন। কেউ ঘুমতে যাবার কথা ভাবতে পারছিলাম না। অথচ আমি আর শাহরিয়ার কখনো এত রাত করি না। একটু রাত হলেই মায়ের বকুনি রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ভেঙে ফেলে, মায়ের দিকে তাকালাম। তিনি আজ আর আমাদের ঘুমতে যাবার তাড়া দিচ্ছেন না। আমার আর শাহরিয়ারের চোখে হানা দিচ্ছিল ঘুম। আমরা অন্য সবার সঙ্গে জেগে অজন্তা’পাকে পাহারা দিচ্ছি।
বছর পনেরো পরের কথা। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। হাজির হাটের স্কুল মাঠে থইথই পানিতে খেলা করছে কতগুলো বাচ্চা। একটা বাচ্চার হাতে দড়ি বেঁধে অন্য বাচ্চারা তাকে উপুড় করে মাঠের কাদা পানিতে শোয়ালো। ওর মাথাটা উপর দিকে তোলা। শ্বাসের সঙ্গে নাকে-মুখে যাতে কাদা পানি না ঢুকে পড়ে। ছেলেটির পরনে ছোট একটা প্যান্ট। আমি স্কুলের পোস্টাপিসের দরজায় দাঁড়িয়ে। বিভোর হয়ে ওদের খেলা দেখছি। ওরা কয়েকজন ওর হাতের রশিটা ধরে টানছে। একজন তার পিঠে উঠে বসে তার বাহু জাপটে ধরল। ঠিক ছোটবেলায় যেমন সুপারির খোলের উপর বসে গাড়ি গাড়ি খেলতাম তেমনি। পিছল মাটির পথে ওরা ছেলেটির হাতে বাঁধা রশি ধরে টানছে। ওর পিঠে বসে থাকা ছেলেটি এবং অন্যরা আনন্দে খলখল করছে। বৃষ্টির তোড়জোড় ভীষণ রকম বেড়ে গেছে। ওরা মাঠের পানিকে মাথায় তুলছে। এতক্ষণ সুপারির খোলে খেলা করা ছেলেটি স্কুলের বারান্দায় উঠে এলো। এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ও বড় বড় করে দম নিচ্ছে। ওর বুকে কাদা পানি আর রক্তের ছিটে দেখা যাচ্ছে। ছেলেটির চোখ লাল। ভেজা চুলগুলো নেতিয়ে আছে। ও এক আজলা বৃষ্টির জল নিয়ে খেলো। আবার জল নিয়ে বুক ধুলো। হঠাৎ ছেলেটি বারান্দায় পড়ে ছটফট করতে করতে বীভৎসভাবে চিৎকার করতে লাগলো। ওর সাথিরা লক্ষ করছে না ওকে। ওরা খেলায় মশগুল। আমি ওদের চিৎকার দিয়ে ডাকলাম। বললাম, ওকে দেখতে। ওরা দৌড়ে এলো ছেলেটির কাছে। ছেলেটিকে চারজনে ভারী বস্তার মতো ধরে ছটলো। আমি ছাতা নিয়ে ওদের পিছু পিছু গেলাম।
হঠাৎ বিস্ফারিত চোখে লক্ষ করলাম ছেলেটির মুখ দিয়ে লালার বদলে রক্ত বেরোচ্ছে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে সে রক্ত। ডিসপেন্সারিতে পৌঁছে ছেলেটিকে বেঞ্চে শোয়ালো ওরা। ছেলেটি ছটফট করতে লাগলো আগের ছেয়ে তীব্রভাবে। ডাক্তার চেক করতে করতে বলল, ‘কী করে হলো?’ আমি কিছু বলার আগেই ওরা বলল, ‘আমরা বৃষ্টিতে খেলছিলাম। হঠাৎ ও কেমন করতে লাগলো। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম।’ ডাক্তার বললেন, ‘ভীষণ খারাপ অবস্থা। ওর ভেজা কাপড় ইমিডিয়েটলি বদলাতে হবে। এই ঘোর বৃষ্টিতে বাড়িতেও পাঠানো সম্ভব নয়। আমার ডিসপেন্সারির পেছনের রুমে রোগী দেখার বেডের চাদর আর আমার চেয়ারের টাওয়েলটা আপাতত তাকে পেঁচিয়ে দেওয়া যাক।’ অতিদ্রুত তাই করা হলো। কাপড় বদলের পর ডাক্তার একটি ইনজেকশান দিলেন। আচমকা ছেলেটি অদ্ভুতভাবে উলট-পালট করতে লাগল। ডাক্তার আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘প্লিজ হেল্পমি।’ আমি ডাক্তারের সঙ্গে ছেলেটিকে চেপে ধরে রাখতে চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ আমার মনে অজন্তা’পার মুখটা ভেসে ওঠে। বুক কেঁপে উঠল। তিনিও এমন করেছিলেন সে রাতে। শেষ রাতের দিকে চলে গেলেন... না! না! আমি সত্যি আর ভাবতে পারছি না। ছেলেটির মুখটা তার মতো ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ওফ কী ভীষণ! কী বীভৎস! ওফ নো!
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : অজন্তা’পা ও ছেলেটি রওশন রুবী গল্প সাহিত্য
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh