পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থাগার
বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগার শুধু একটি স্থান নয়, বরং এটি ছিল জ্ঞানের এক অমূল্য সংগ্রহশালা, যেখানে মানব জাতির চিন্তা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের সব দিকের চিত্র একত্রিত হয়েছিল। আজও এই গ্রন্থাগারের ইতিহাস পৃথিবীর জ্ঞানপ্রেমী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। এটি হলো ‘আশুরবানিপাল গ্রন্থাগার’, যা বিশ্বের প্রথম পরিচিত ও বৃহৎ গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়, আধুনিক ইরাকের নিনেভেহ শহরে সপ্তম শতাব্দীতে।
গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আসিরীয় সম্রাট আশুরবানিপাল, যিনি ছিলেন শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিপ্রেমী একজন শাসক। আশুরবানিপাল শুধু একজন সাহসী শাসকই ছিলেন না, তিনি এক পুঁথি সংগ্রাহকও ছিলেন। কখন তিনি তার গ্রন্থাগারের পরিকল্পনা করেছিলেন তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে ধারণা করা যায়, তার শাসনকালের পুরোটা জুড়েই তিনি এর সংগ্রহশালা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে গেছেন। তার অধীনে শাসকদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের রাজ্যের যত লিখিত গ্রন্থ আছে সব তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। সেই সময় লেখার জন্য মাটির চতুষ্কোণ ব্লক বা ট্যাবলেট ব্যবহার করা হতো।
এই গ্রন্থাগারটি ছিল আশুরবানিপালের রাজপ্রাসাদে এবং সেখানে গুছানো ছিল সিলযুক্ত মাটির তালিকা। এই তালিকাগুলোর মধ্যে রাজার বিশেষ আদেশ, ধর্মীয় লিপি, রাজত্বের হিসাব, কাব্যগ্রন্থ, চিকিৎসাবিষয়ক পুঁথি এবং আরো নানা ধরনের ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক লেখনী ছিল। রাজা নিজে এই পুঁথিগুলো সংগ্রহ করতেন এবং লেখকদের উৎসাহিত করতেন এসব গ্রন্থ রচনা করতে।
গ্রন্থাগারের বেশির ভাগ পাঠ্যই মূলত আক্কাদীয় ভাষায় কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা হয়েছিল এবং অন্যগুলো আসিরিয়ান ভাষায় লেখা। আশুরবানিপাল ছিলেন একজন চমৎকার গণিতবিদ এবং খুব কম সম্রাটদের একজন, যারা আক্কাদিয়ান এবং সুমেরীয় উভয় ভাষায় কিউনিফর্ম লিপি পড়তে পারতেন।
আশুরবানিপাল গ্রন্থাগারের গুরুত্ব শুধু এর সংগ্রহের জন্য নয়, বরং এর সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যের জন্যও ছিল অমূল্য। এখানে ছিল প্রাচীন বেবিলনীয়, আক্কাদীয়, সুমেরীয় ও আসিরীয় সভ্যতার সব ধরনের পুঁথি ও লিপি। এখানে যেমন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল, তেমনি ছিল ধর্মীয় পুঁথিও। এ ছাড়া ছিল গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভূগোল ও চিকিৎসাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। আশুরবানিপাল গ্রন্থাগারের একটি বিশেষ দিক হলো এখানে ছিল প্রাচীন ঐতিহাসিক দলিল, যা সেই যুগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং শাসককুলের কার্যক্রম সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা করেছে।
গ্রন্থাগারে এপিক অব গিলগামেশসহ (Epic of Gilganesh) বিখ্যাত মহাকাব্যের সংরক্ষণ ছিল। আরো ছিল তখনকার আইন ও শাসন ব্যবস্থার বিস্তারিত নথিও। এতে এমন কিছু মূল্যবান তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, যা আজও বিশ্ব ইতিহাসের একটি অমূল্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নিনেভেহ শহরটি ৬১২ খ্রিস্টপূর্বে বেবিলনীয়দের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। অ্যাসিরীয়দের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ থেকে শত্রুরা নিনেভহকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। পুড়ে যায় গ্রন্থাগারের হাজার হাজার কাঁচা পুঁথি, শিলালিপি ও মূল্যবান লেখনী। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়াম পরিচালিত প্রজেক্টে নিনেভহ শহর খননের সময় সর্বপ্রথম ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক অস্টিন হেনরি লিন্ড এই লাইব্রেরির সন্ধান পান। এর পর থেকে খননকাজের মাধ্যমে সময় সময় গ্রন্থাগারের বিভিন্ন অংশ উন্মোচিত হয়। বর্তমানে ৩০ হাজারটির বেশি মাটির পুঁথি, শিলালিপি এবং গ্রন্থাবলি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো মূলত লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, প্যারিসের লুভর মিউজিয়াম ও মস্কোর পুশকিন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব গ্রন্থের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে।
আশুরবানিপাল গ্রন্থাগারটি ছিল এক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানে যে জ্ঞান ও লেখনী সংরক্ষিত ছিল, তা শুধু আসিরীয় রাজত্বের সীমানায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি প্রাচীন পৃথিবীর বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও সাহিত্যের অমূল্য ধন। ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই গ্রন্থাগারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বলে শেষ করা যাবে না। এর সুবিশাল সংগ্রহ আসিরীয় সাম্রাজ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
আশুরবানিপাল গ্রন্থাগার ছিল পৃথিবীর প্রথম বৃহৎ গ্রন্থাগার এবং এটি প্রাচীন মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীক। যদিও এটি ধ্বংস হয়ে গেছে, তার পরও এটি আমাদের জন্য প্রেরণা হয়ে আছে। এই গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধ সংগ্রহ এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও আমাদের শেখায় যে, মানবসভ্যতা কখনো হারায় না, নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে আবারও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh