ষাটের দশক বা তারও আগে যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামে, তারা জীবিকার তাগিদে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তাদের স্মৃতিচারণা গ্রামের পুরুষদের মেয়ে সেজে নাটক, যাত্রাপালা, জারি, নববর্ষের মেলা, বাউলগান, কবিগান, কিচ্ছা বা পুঁথিপাঠের আসর ও ঘাটুগান মিশে আছে আত্মায়, মনে ও মননে। সন্ধ্যা হতেই বিদ্যুৎবিহীন অজপাড়াগাঁয়ে নেমে আসত মধ্যরাতের নীরবতা। শীতকালে গৃহস্থ কর্তা ধান মাড়াই শেষে কিংবা বর্ষায় একটানা সাত-আট দিন বৃষ্টিতে ঘরবন্দি অবস্থায় আয়োজন করতেন কিচ্ছার আসর, গানের আসর, পুঁথিপাঠ তার সঙ্গে আয়োজিত হতো ঘাটুগানের। হ্যাজাক লাইট কিংবা হারিকেন অথবা কুপিবাতির আলোয় গানের আড্ডা চলত মধ্যরাত-অবধি।
হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারক বাংলার বাঙালি, যা ধারণ করে বাঙালিয়ানার খুঁটি ধরে রেখেছে আবহমান কাল ধরে। নববর্ষ, নবান্ন, পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি, মশামশির মুখ পোড়া, দিওয়ালি বা দীপাবলি, নৌকা দৌড়, গরু দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পুঁথিপাঠ, কিচ্ছা বলার আসরসহ সব সাংস্কৃতিক আয়োজনে। তেমনি ঘাটুগানের আসর ছিল তখনকার সময়ের লোকসংস্কৃতির একটি উপজীব্য অনুষঙ্গ। জশোরী বাজনা বাজিয়ে চলত ঘাটুগান। বারো মাসের তেরো পার্বনের সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশের সামাজিক পথচলা। বাংলাদেশ শুধু তার লোকসংগীত নিয়েই সমৃদ্ধ নয়, বিশ্ব লোকসংগীতের ভান্ডারও বাংলাদেশের জনপদ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ছয় ঋতুতে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির ছন্দময় অভিব্যক্তি, সুজলা-সুফলা বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো,
ধর্মীয়-সামাজিক ভূমিকা রেখে চলছে। ঘাটুগানের উদ্ভব ও বিকাশ অন্য সব লোকসংগীতের মতোই। এর পেছনে ভৌগোলিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট যোগ হয়েছে। ঘাটুগান হলো খাল-বিল, নদীনালা, হাওর-বাঁওড় অধ্যুষিত ভাটি অঞ্চলের লোকসংগীত। ভাটি অঞ্চলের সংস্কৃতির মূলধারাটা এসেছে ঘাটুগান থেকেই। ঘাটুগান ভাটি অঞ্চলের গান। উজানে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ থেকে ত্রিপুরার উত্তরাংশ এবং ময়মনসিংহের যেখানে শেষ, সেখান থেকে ভাওয়াল হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ঘাটুগানের বিস্তার হয়েছিল প্রকৃতিগত ও সমমনা একই রুচির সংস্কৃতি বলে। ভাটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ছয় মাস বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে ভাসমান থাকে। চারদিকে থইথই করে পানি। কাজকর্ম থেকে অগাধ অবসর পাওয়া মানুষগুলো মেতে ওঠে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে। ঘাটুগানের আসর তার মধ্যে অন্যতম। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ঘাটুগানের প্রচলন বলে ধারণা করা হয়। এই গান বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে প্রচলন ছিল। গবেষণা মতে, শ্রীকৃষ্ণের প্রেমমগ্ন কোনো এক ভক্ত রাধা সেজে কৃষ্ণের অপেক্ষায় থাকত। তখন তার বেশ কিছু ভক্ত গড়ে ওঠে। এই ভক্তদের মধ্য হতে ছেলেশিশুদের রাধার সখি সাজিয়ে নেচে নেচে বিরহ বিধুর সংগীত পরিবেশন করা হয়, আর এভাবেই প্রণয় বিরহ নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে প্রচলন হয় ঘাটুগানের। ভাটি এলাকার গান বলে পরিচিত ঘাটুগান ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ, ঈশ্বরগঞ্জ, কেন্দুয়া ও নেত্রকোনা, সিলেটের হাওর অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। ঘাটুগানের বিশেষত্ব হলো, নারী বেশে সুদর্শী কিশোর বালক নৃত্য সহযোগে ঘাটুগান পরিবেশন করে। মেয়েলি চেহারার ছেলেটাকে পায়ে ঘুঙুর, ঘাগড়ি বা শাড়ি, ম্যাচিং করা ব্লাউজ, ব্লাউজের নিচে নারকেলের শুকনা আচ্ছি দিয়ে বানানো উঁচু স্তন, কানে দুল, দুই হাতে রঙিন চুড়ি, হাতে রুমাল বেঁধে মঞ্চে উঠাত। একজন লোক থাকত ঘাটুকে পরিচালনার জন্য। ঘাটুগানে সহযোগিতা করার জন্য। ঘাটুর সঙ্গে নাচে, কথায়, প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়ায়। এই লোকটাকে বলা হতো মরাধার বা গীতিকার বা প্রমটার। মরাধারের পড়নে থাকত ধূতি ও চাদর, মাথায় সালু কাপড়ে বাঁধা। ঘাটু বালকটির মেয়েলি ঢং, কথা বলার ধরন, হাত নাড়ানো, ঘন ঘন চোখের পলক ফেলা, তাকানোতে মেয়েলি ভঙ্গি, মেয়েলি ভাব, বাস্তব জীবনেও মিশে যেত। ওখান থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারত না।
এ বিষয়ে গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘ঘাটুগানের সময়ই ছিল বর্ষা ও শরতকাল। পূর্ব মৈমনসিংহের বিস্তৃত জলাভূমির মধ্যে যখন বর্ষার জল সঞ্চিত হইয়া হাওর বা সাগর বলিয়া ভ্রমোৎপাদন করে, সেই সময়ই ঘাটুগানের সময়। হাওরের বুকে বিস্তৃত নৌকার পাটাতনের ওপর ঘাটুগানের আসর বসত। তারপর হাওরের প্রান্তবর্তী গ্রামগুলোর ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া দিবারাত্রি অব্যাহত এই ঘাটুগান চলিতে থাকে।
প্রাচীন যুগে সামন্ত প্রভুরা অন্দর মহলে বাঈজির নাচ-গানের আসর বসাতেন। তাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ ছিল। সে সময়ে কিছু মধ্যবিত্ত শৌখিন মনের যুবকদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ঘাটুগানের প্রচলন। ঘাটুগানের উৎস কোথায় তা মতভেদ থাকলেও এটা সমাদৃত ও সর্বজন গৃহীত যে, প্রায় চারশত বছর আগে বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ থানার উদয় আচার্য ছিলেন ঘাটুগানের প্রবর্তক। তার মাধ্যমেই ঘাটুগানের প্রবর্তন। তখন ঘাটুগান গাওয়া হতো পূজায়, রাধা-কৃষ্ণের পদাবলি বর্ণনে; পবিত্র মাধ্যম হিসেবে। উদয় আচার্যের মৃত্যুর পর ঘাটুগানকে বাণিজ্যিকভাবে আদি রসাত্মক কথাবার্তা যোগ করে রচিত হয়ে আগের ধরন থেকে বেরিয়ে আসে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh