প্রচ্ছদের ভাষা

‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি’- প্রবাদটি বইয়ের ক্ষেত্রেও খাটে। কেননা পাঠক প্রথমে আকৃষ্ট হয় বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে, যদি না বইটি সম্পর্কে তার পূর্ব ধারণা থাকে।

পাঠক বই কেনে নানা কারণে। কখনো লেখকের নামের কারণে; কখনো বিষয়বস্তু, আবার কখনো বইটি আলোচিত হওয়ার কারণে। সে রকমই কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ যদি পাঠককে আকৃষ্ট করে, তাহলেও তিনি ওই বইটি কিনতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায় যে, খুবই ভালো বা গুরুত্বপূর্ণ বই হওয়া সত্ত্বেও তার প্রচ্ছদটি আকর্ষণীয় নয়। অনেক সময় হালকা-চটুল বইও প্রচ্ছদের কারণে উতরে যায়। সব মিলিয়ে বইয়ের দুনিয়ায় প্রচ্ছদ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা এখন একটি বিরাট শিল্প। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলা সামনে রেখে তার দুই-তিন মাস আগে থেকে অনেক প্রচ্ছদশিল্পীর দিনরাত একাকার হয়ে যায়।

বাংলাদেশে বর্তমান প্রচ্ছদশিল্পের এক দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। একসময় প্রচ্ছদ হতো কাঠের ব্লকে, অতঃপর জিংক, তারপর লাইনোর পথ অতিক্রম করে সাম্প্রতিক প্রচ্ছদ নির্মাণে যুক্ত হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি।

শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং কাজী আবুল কাশেমই মূলত বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের পথিকৃৎ। জয়নুল কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়ার সময় হানাফি পত্রিকায় কার্টুন, টেবিল ল্যাম্পের শেডচিত্রণ ও বুলবুল পত্রিকায় স্কেচ অঙ্কন করতেন। সেই সঙ্গে তিনি প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন।

কাজী আবুল কাশেমের প্রচ্ছদে গ্রামীণ জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় উপাদানের সন্নিবেশ ঘটে। এরপর শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী ক্যালিওগ্রাফি এবং গ্রামীণ পটভূমি নিয়ে প্রচ্ছদ এঁকেছেন। শিল্পী হাশেম খানের অলংকরণ ও প্রচ্ছদগুলো বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পে ক্ল্যাসিক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়া কালাম মাহমুদ, রফিকুন নবী, আবুল বারক আলভী, কাজী হাসান হাবিবও বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ধ্রুব এষ, সব্যসাচী হাজরা ও চারু পিন্টুর মতো শিল্পীরা বইয়ের প্রচ্ছদকে নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়।

বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে কথা হয় শিল্পী সব্যসাচী হাজরার সঙ্গে, যিনি প্রচ্ছদে বরাবরই অক্ষর বা টাইপোগ্রাফিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সব্যসাচী বলেন, ‘টাইপোগ্রাফির কাজ আমাদের এখানে আদিতে অনেক বেশি হতো। ষাট সত্তর আশির দশকে। কাইয়ূম চৌধুরী, কাজী হাসান আরিফ বা দেবদাস চক্রবর্তীর মতো শিল্পীরা প্রচুর প্রচ্ছদ করেছেন টাইপোগ্রাফি দিয়ে। এমনকি খালেদ চৌধুরী, সত্যজিৎ রায় বা পূর্ণেন্দু পত্রীও একই ধারায় বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। কিন্তু আপনি দেখবেন যে গত এক দশক ধরে টাইপোগ্রাফির কাজ অনেক কম। তার একটি কারণ প্রযুক্তি আমাদের সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। ফলে শিল্পীরাও সেই সুযোগটা নিচ্ছেন। কেননা মেলার সময় একসঙ্গে প্রচুর বইয়ের কাভার করতে হয়। কিছু শিল্পীর ওপর ভীষণ চাপ পড়ে। ফলে টাইপোগ্রাফি দিয়ে তারা ধীরেসুস্থে অনেক সময় নিয়ে যে প্রচ্ছদ করবেন, তা থাকে না। ফলে কাজটি দ্রুত নামাতে গিয়ে তারা প্রযুক্তির সহায়তা নেন। ফলে আমি দেখলাম যে, এই জায়গাটা ফাঁকা আছে।’

সব্যসাচী বলেন, ‘এটা ঠিক যে, আমি প্রচুর প্রচ্ছদের কাজ নিই না। আগে বইয়ের কনটেন্ট দেখি। পড়ি। পুরো বইটা পড়তে না পারলেও অন্তত বইটা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করি। ধরা যাক কবিতার বই। প্রচ্ছদ করার জন্য তার তো সব কবিতা পড়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি এও মনে করি যে, কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করা সবচেয়ে বেশি কঠিন। কেননা কবি যা লিখেছেন, যা বলতে চেয়েছেন, সেই অনুভূতিটা শিল্পীর পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন। কবিতায় অনেক সময় কবির নিজস্ব কিছু ব্যাপার থাকে। সেটা তো শিল্পী নাও ধরতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমি কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে সম্ভব হলে কবির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি।’

সিরিয়াস বা একাডেমিক বইয়ের ক্ষেত্রে কী করেন? সব্যসাচী বলছেন, ‘আমি যদি সেটার বিষয় না বুঝি, তাহলে প্রচ্ছদ আঁকব কী করে? ফলে আমি যদি মনে করি যে বিষয়টি দাঁড় করাতে পারব, তাহলেই কাজটা করি এবং আপনি বলতে পারেন যে, আমি এখনো টাইপোগ্রাফিকেই প্রাধান্য দিই। তবে টাইপোগ্রাফি দিয়ে প্রচ্ছদ বানানোর চ্যালেঞ্জ হলো অক্ষরের প্রতি বা ক্যালিগ্রাফির প্রতি শিল্পীর বিশেষ আগ্রহ থাকতে হয়, দক্ষতা থাকতে হয়।’

বইয়ের প্রচ্ছদে কি আপনি সবটুকু বলতে পারেন? ‘না। আমি আসলে কভারে সব গল্প বলতে চাই না। ধরুন, ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই। আমি প্রচ্ছদে সেটা কীভাবে বলব? ফলে আমার ভাবনায় থাকে প্রচ্ছদটা পাঠককে ছুঁয়ে যাবে কি না বা অন্য বইগুলোর সঙ্গে তার একটু পার্থক্য থাকবে কি না। একই লেখকের যদি পাঁচটি একই ধরনের বইয়ের প্রচ্ছদ করি, সেখানে কীভাবে বৈচিত্র্য আনা যায়, সেটিও ভাবনায় থাকে। আমি একটু কম রং ব্যবহার করি। নির্দিষ্ট কিছু রঙে আমি সীমাবদ্ধ থাকি এবং রঙের এই পরিমিত ব্যবহার আমার কাজটা সহজ করে দেয়।’

২০১৪ সালে প্রকাশিত শিল্পসাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ভিন্নচোখ’-এর ভাষা সংখ্যায় প্রচ্ছদশিল্প নিয়ে একটা আলাপচারিতায় কথা বলেন ধ্রুব এষ, সব্যসাচী হাজরা ও চারু পিন্টু। সেই আলাপচারিতায় তারা বলেন, ‘আমাদের শিল্পসাহিত্যের অভিধানে প্রচ্ছদ শব্দটির একটি ভিন্ন তাৎপর্য আছে। বইয়ের ক্ষেত্রে লেখনী এবং প্রচ্ছদের ব্যবহারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বইগুলোর প্রচ্ছদ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত এবং অনেক মূর্ত। এত নান্দনিক, এত রঙের ব্যবহার, ড্রইং কনসেপ্ট মনে হয় পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় বা দেশে ব্যবহৃত হয় না। আমাদের বাংলায় লেখনীর ঢঙগুলো একেবারেই মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। আর সেভাবেই প্রচ্ছদের ঢঙগুলোও তার লেখনীর সঙ্গেই মিলেমিশে অনিবার্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই থাকে।’

এই আলাপচারিতায় সব্যসাচী হাজরা বলেন, সাহিত্যকর্ম বইয়ের প্রাণ। প্রচ্ছদ তার বহিরাবরণ। বইয়ের প্রচ্ছদ বিষয় নিরপেক্ষ ক্যানভাস নয়। কিন্তু কিংবদন্তি শিল্পীর হাতে সৃষ্টি হওয়া প্রচ্ছদ বিষয় ভাবনায়, প্রকাশব্দীতে মূল সাহিত্যের চেয়েও ঋদ্ধ বা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। রান্নার স্বাদের চেয়ে পরিবেশনা সুন্দর হতে পারে, বিষয়টি আপেক্ষিক এবং তুলনাটা তখনই করা যৌক্তিক যখন লেখক ও প্রচ্ছদকার দুজনেই নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

প্রচ্ছদ কি বইয়ের বিজ্ঞাপন না শিল্প? এমন প্রশ্নের জবাবে সব্যসাচী হাজরা বলছেন, ‘বিজ্ঞাপন নিজেও একটি শিল্প। প্রচ্ছদ বইয়ের বিজ্ঞাপন নয়। তবে বইয়ের সফল বিপণনে সহায়ক হতে পারে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করতে পারে শিল্পকর্ম। নিজেই অন্তর্দর্শনে শিল্পের বিজ্ঞাপন। পণ্যের প্রসারে বাণিজ্যিক প্রচারণাকে যদি বিজ্ঞাপন বলা হয়, প্রচ্ছদ নিজে সে ক্ষেত্রে পণ্যের অব্যবহৃত উপাদান, বইয়ের বিজ্ঞাপন নয়।’

চারু পিন্টুর ভাষায়, ‘প্রচ্ছদ সব সময় শিল্প, এটা কখনই বিজ্ঞাপন নয়। বিজ্ঞাপনের ভাষাই আলাদা। বিজ্ঞাপন আবর্তিত হয় বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে, আর শিল্পকে ঘিরেই হয় প্রচ্ছদ।’

বলা হয়, ব্যক্তি মানুষের সৌন্দর্যের জন্য যেমন পোশাক প্রয়োজন, তেমনি একটি সুন্দর বইয়ের জন্য প্রয়োজন সুন্দর প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদের নান্দনিকতা বইয়ের নতুন মাত্রা যোগ করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh