এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট

মঞ্চের পর্দা সরে যায়। চার শতাধিক বছরের প্রাচীন সমাধিক্ষেত্রে উপনীত বর্তমানকালের রাত্রীচর কবি। হঠাৎ জ্যোৎস্না সক্রিয় হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি নির্মাতা উইলিয়াম শেক্সপিয়রের দুই অমর চরিত্র রোমিও ও জুলিয়েট। ঘোর অন্ধকার সমাধিক্ষেত্রের প্রাঙ্গণ মৃত্যুগন্ধে ভরপুর।

আত্মহত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে চিরমিলনের আনন্দধামে পৌঁছে যাওয়া আত্মহারা রোমিও ও জুলিয়েট। শতকের পর শতকজুড়ে বিশ্বময় স্বীকৃত তাদের সন্দেহাতীত প্রেমকাহনে একালের দার্শনিক কবি চন্দ্রাহত মুহূর্তে ছুড়ে দিতে থাকেন একের পর এক সন্দেহজাগানিয়া যৌক্তিক প্রশ্ন। যে রোমিও রোজালিনের প্রেমে পীড়িত, যে রোমিও উন্মত্ত হয়ে রোজালিনকে খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়েছিল, সেই রোমিওই কি করে দুনিয়ার শিল্পামোদিদের কাছে অমর চরিত্র হয়ে উঠতে পারল জুলিয়েটের প্রতি তার রূপমুগ্ধতাজনিত প্রেমের কারণে? রোমিওর প্রেম আসলে কার প্রতি? রোজালিন? নাকি জুলিয়েট? কেবলই কি জুলিয়েটের শরীরের প্রতিই রোমিওর প্রেম?

আজ এই একবিংশ শতকে এ যুগের বিপ্লবী চিন্তক কবির অনুসন্ধানী প্রশ্নগুলো কেবল যে প্রেমান্ধ জুলিয়েটের হৃদয়কেই এলোমেলো করে দেয় তা নয়, দ্বান্দ্বিক করে তোলে শেক্সপিয়রের তাবৎ নিবেদিত পাঠক-দর্শককে। আজকের চিন্তক কবির মনোভূমিতে আবিষ্কৃত রোমিও ও জুলিয়েট নামক প্রেমাখ্যান গুপ্ত চাতুরিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কি করে প্রশ্নাতীত শিল্পসত্য হয়ে রইল- সে এক বিস্ময় বটে। শেক্সপিয়ারিয়ান বিস্ময়। যেমন, ফাদার ফায়ার, মানব সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতিনিধি হয়েও বিরোধপূর্ণ দুই পরিবারের দুই প্রেমাসক্ত নারী-পুরুষের বিবাহ গোপনে দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত গোপন রাখলেন। এবং তা যেন প্রকাশ না হয়- সে জন্য অনৈতিক চাতুরির আশ্রয় পর্যন্ত নিলেন। 

জুলিয়েটকে রক্ষা করার নামে তার হাতে তুলে দিলেন চেতনানাশক মদিরা। যার কারণে প্রথমে আত্মহত্যা করতে হলো রোমিওকে, তারপর তথাকথিত দৈব পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করতে হলো জুলিয়েটকেও। অথচ কয়েক শত বছর কেউ জানতে পারল না কেন ফাদার এমনকিছু একশনের জন্ম দিলেন যার কারণে শৈল্পিক ট্র্যাজেডি অনিবার্য হয়ে উঠল! এতদিনে প্রকাশ করা সম্ভব হলো, ফাদারিয় পবিত্রতা রক্ষাই কেবল নয়, ফাদার পদে টিকে থাকার স্বার্থে এ জাতীয় গোপন খেলা বিশ্বাসের নেতাদের খেলতে হয়। ধর্ম ব্যবসার এ এক চিরায়ত ক্রীড়া। না কি ফাদার ফায়ারের কিছু করার ছিল না এখানে! যা করার করেছেন মহাত্মা শেক্সপিয়ার। সেজন্যই হয়তো চারশতাধিক বর্ষ পরের এক কবির অনুসন্ধানী দার্শনিক প্রশ্নের সামনে ভেঙে পড়ে শেক্সপিয়রের সৃষ্টিশীল অমর আত্মা। শেক্সপিয়র চরিত্রের মাধ্যমে রোমিও ও জুলিয়েট আখ্যানের দৌর্বল্য স্বীকার করিয়ে নেওয়ার শিল্পবাস্তবতাকে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কবি’ শেক্সপিয়ারের পরম মহত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন; আর তাই, দুনিয়ার সর্বকালের সেরা নাট্যকারের প্রতি ‘কুর্ণিশ’ জানান। 

আর জুলিয়েট? তার কি হয়। চন্দ্রাহত সমাধিক্ষেত্রে শিল্পসত্যের কঠোর এন্টি-থিসিসের মুখোমুখি হয়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও বিক্ষত হয়ে পড়ে জুলিয়েট। যে রোমিওর প্রেমালিঙ্গনে রোমাঞ্চিত আর্ট-লাইফ ও আফটার-ডেথ মিথের জগৎ উপভোগ করছিল চার শতাধিক বর্ষাকাল, সেই রোমিওর প্রতি ঘৃণা জন্ম নিল জুলয়েটের সদ্য যুক্তিস্পৃষ্ট হৃদয়ে। প্রতিনিধিত্বশীল চিরায়ত প্রেমিকা হিসেবে এই প্রথম পুরুষতান্ত্রিক প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস অর্জন করল জুলিয়েট। নিজের নতুন উপলব্ধিসম্পন্ন স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সম্পন্ন এই জুলিয়েট নাট্যকার সাইমন জাকারিয়ার জুলিয়েট। আত্মহননের চার শতাব্দীর বেশি সময় পর, জুলিয়েট যেন নারীবাদী সমসাময়িক জুলিয়েট হয়ে ওঠেন। 

ক্ল্যাসিক সাহিত্য বা অন্য , যে কোনো শিল্পের ডাইভার্স মিনিং পরিবেশনা শিল্পের ভেতর দিয়ে কী অসধিরিণভাবেই না করা যায়- এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের প্রদর্শনী যেন তারই কার্যকর ডেমোনেস্ট্রেশন। নাটকটি দেখে দর্শকমনে এ প্রশ্ন জাগতেই পারে- সাইমন জাকারিয়া কি শেক্সপিয়রকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দু’ভাবেই দেওয়া যায়। ‘হ্যাঁ’, এ কারণে যে, যে কোনো সত্যকে কেবল সত্যরূপের চমক ও শক্তির নিরিখে যুগের পর যুগ একরূপে গ্রহণ ও লালন করা সম্ভব, এবং নাট্যকার সে অবস্থান ভেঙে দিয়েছেন। আবার, ‘না’; কেননা, সত্যের তো অনেক রূপ; সেই বহুরূপের সন্ধান করা শিল্পের অন্যতম কাজ। সত্য, ফলে, আপেক্ষিক। এই আপেক্ষিকতার এক অসামান্য যৌক্তিক রূপ দেখতে পাওয়া গেল সাইমন জাকারিয়া বিরচিত ও নূর জামান রাজা নির্দেশিত এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকে। 

এ ধরনের সৃষ্টিশীল চিন্তাকেন্দ্রিক নাটক ঢাকার মঞ্চে নিঃসন্দেহে বড় রকমের চমক। একে নতুন এদেশের মঞ্চনাটকের শক্তিমত্তার প্রকাশ দেখা গেছে। নতুন নাট্যদল এম্পটি স্পেস এই নতুন চিন্তার নাটকটি ঢাকার মঞ্চে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলা নাট্যজগতে অন্য এক সাহসী ঘরানার জন্ম দিল। সাহসী ঘরানা বলছি এ জন্য যে, এ নাটক শেক্সপিয়রের মহৎ ট্রাজেডির গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লুপহোলগুলো উন্মোচন করার প্রয়াস পেয়েছে এবং তা পরিবেশন করেছে পুরোপুরি নতুন একটি নাট্যদল। বাংলাদেশের মঞ্চসারথি আতাউর রহমান ও গোলাম সরোয়ারের পরামর্শ অনসরণ করে এই নাটক তৈরির নির্দেশক, অভিনয় শিল্পীরা ও অন্যান্য কলাকুশলী কাজ করেছেন। সবাই বয়সে নবীন। অভিজ্ঞতাতেও কাঁচা। তবে, প্রত্যয়ে, নিষ্ঠায় যথেষ্ট পরিপক্ব। মঞ্চ পরিকল্পনা, আলোক সজ্জা, আবহ সঙ্গীতসহ পুরো পটভূমি রচনায় তারুণ্যের প্রতিরূপ দর্শকদের দৃষ্টি এড়ায়নি নিশ্চয়।

এটা ঠিক, নাটকটির প্রথম প্রদর্শনীতে পরিবেশনা শিল্পীদের উন্নয়নযোগ্য বেশকিছু দিক নজরে এসেছে। মূল চরিত্র (কবি) রূপায়নকারী হিসেবে গোলাম শাহরিয়ার সিক্ত বাংলা মঞ্চে তার আসন পাকা করে নিলেন বলে মনে করি। তবে সংলাপ আয়ত্ব করার ক্ষেত্রে তিনি আরও পরিশ্রমী হবেন এ প্রত্যাশা রয়ে গেল। নূর জামান রাজা অসাধারণ নির্দেশনা দিয়েছেন সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়; এবং তিনি অভিনয়ও করেছেন। কঠিন কাজ নিশ্চয়। তবে তার অভিনয়ের প্রতি আরও মনোযোগী হবার সুযোগ রয়ে গেছে। আন্ডারটোন প্রক্ষেপণ দর্শকদের কানে অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছায়নি। জুলিয়েটের ক্ষেত্রেও, লোবা আহমেদ, সংলাপ প্রক্ষেপণে প্রয়োজনীয় ভ্যারিয়েশনগুলোর প্রতি নিশ্চয় আরও মনোযোগী হবেন পরের প্রদর্শনীগুলোতে। শেক্সপিয়ারের চরিত্র রূপায়নকারী স্বাধীন বিশ্বাসকে শেক্সপিয়ার হিসেবে কম বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে খানিকটা অতি অভিনয়ের ছাপও চোখে পড়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের সাম্প্রতিক একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এম্পটি স্পেসের উত্তরণ দর্শক হিসেবে আমার আন্তরিক প্রত্যাশা। সেজন্যই চরিত্রগুলোর রূপায়ন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠবে- এ আমার একান্ত কামনা। বাপ্পি সরদার ও রফিকুল আউয়ালের নিষ্ঠার প্রশংসা না করে পারছি না। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্ট্যাচু হয়ে মঞ্চে থাকার জন্য শরীর-মনে যে বিশেষ তাকৎ প্রয়োজন, তা তাদের আছে। ফাদার ফায়ার উৎড়ে গেছেন।

ঘটনাচক্রে এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের টেক্সট আমাকে একাধিকবার পাঠ করতে হয়েছে। যতদূর জানি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ নাটকটি একাডেমিক কোর্সের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সেগুলোর কোনোটাই আমার দেখা হয়নি। তবে, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ জাতীয় নাট্যশালায় এম্পটি স্পেস এর প্রারম্ভিক প্রদর্শনী একদিকে ছিল মুগ্ধকর, আরেকদিকে নতুন এই দলটির প্রতি কিছু প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে দর্শকমনে। পাত্র-পাত্রীদের সংলাপগুলোকে যথেষ্ট ইন্টার‌্যাকটিভ করে তোলার কাজটি করার জন্য নির্দেশক আগামী প্রদর্শনীগুলোতে সচেষ্ট হবেন নিশ্চয়। সংলাপগুলোর ওজোন ও গমক এবং আখ্যান প্রবাহের গতিবৃদ্ধির দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য দলের সবার প্রতিই অনুরোধ রইল। আবহসংগীত দুই-এক জায়গায় সংলাপকে সুপারসিড করেছে, সেখানেও বিশেষ যত্নের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে আন্তর্জাতিক মানের শীর্ষে দেখার আকাক্সক্ষা থেকেই নতুন দলটির কাছে এই প্রত্যাশা রাখলাম। 

তবে, এম্পটি স্পেস শেক্সপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডির ভিন্ন ও অনুক্ত এক ডিসকোর্স মঞ্চে উপস্থাপন করে বাংলা নাট্যমঞ্চে একটি বিপ্লবী কার্য করেছে। প্রথম মঞ্চায়নে কিছু দুর্বলতা থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, দলের সদস্যদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় সহজেই লক্ষ্য করা যায়। আত্মপ্রত্যয়ী তারুণ্যই ঐতিহাসিকভাবে পরিবর্তনের সারথি হয়েছে। এম্পটি স্পেস হয়ে উঠুক বাংলা নাটকের অদম্য ঘোড়সওয়ার। এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের শততম প্রদর্শনীর অপেক্ষা করব।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //