বাংলাদেশের নকশিকাঁথা

সাধারণভাবে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী ঘর-গেরস্থালির কাজের অবসরে নকশিকাঁথা তৈরি করে থাকে। শুধু বিছানায় বিছানোর জন্য বা গায়ে দেবার জন্য নয়- এর আরও অনেক ব্যবহারিক দিক আছে। যেমন, পালকিতে বিছাবার জন্য এক বিশেষ ধরনের নকশিকাঁথা তৈরি করা হয়। আবার বিয়ের আসর বা বিছানায় শখ করে বিছানো হয় যে কাঁথা তার নাম ‘পাড়নী কাঁথা’। এ ছাড়াও নকশি আসন, নকশি জায়নামাজ, নকশি দস্তরখানা, বর আসন, কনের আসন, বালিশের আবরণী, আয়না-চিরুনী/পান সুপারী রাখার জন্য আরশীলতা বা বটুয়া ইত্যাদি শ্রেণির কাঁথা তৈরি হয়ে থাকে।

সুচের উৎপত্তির সঙ্গে কাঁথা কিংবা নকশিকাঁথার বিশেষ যোগসূত্র আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাষ্য মতে, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় (খ্রি.পূ. ৩০০০-১৫০০ অব্দ) মানুষ সুচের ব্যবহার জানত। সে হিসাবে অন্তত সাড়ে তিন হাজার বছর কিংবা তার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে কাঁথার প্রচলন হয়ে থাকতে পারে। সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্বকাল থেকে বাংলায় কন্থা বা কাঁথার প্রচলন আছে বলে মনে করা হয়। পাণিনির ব্যাকরণ ও অন্যান্য সংস্কৃত ও পালি গ্রন্থে কাঁথার উল্লেখ আছে। নাথ সাহিত্যে গোপীনাথের গানেও কাঁথার উল্লেখ আছে। তবে এগুলো চিত্রিত বা নকশিকাঁথা ছিল কিনা- তা জানা যায় না। তবে কাঁথার প্রাচীনতা অস্বীকারও করা যায় না।

অনেকে মনে করেন, সংস্কৃত ‘কন্থা’ থেকে বাংলা ‘কাঁথা’ শব্দের উৎপত্তি। সাধারণত কয়েকটি পুরনো কাপড় (শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি) জোড়া দিয়ে সেলাই করে কাঁথা প্রস্তুত করা হয়। প্রধানত শীত নিবারণের জন্য কাঁথা প্রস্তুত হলেও এর আরও বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। সাধারণ কাঁথায় যখন নকশা করা হয় তখন তা নকশিকাঁথা নামে পরিচিতি পায়। নকশিকাঁথা নির্মাণে নারীদের ভূমিকা একচেটিয়া। গ্রাম-বাংলার নারীদের হাতেই নকশিকাঁথা সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের হাতেই এর বিকাশ ও প্রবাহমানতা নির্ভরশীল।

সাধারণভাবে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী ঘর-গেরস্থালির কাজের অবসরে নকশিকাঁথা তৈরি করে থাকে। শুধু বিছানায় বিছানোর জন্য বা গায়ে দেবার জন্য নয়- এর আরও অনেক ব্যবহারিক দিক আছে। যেমন, পালকিতে বিছাবার জন্য এক বিশেষ ধরনের নকশিকাঁথা তৈরি করা হয়। আবার বিয়ের আসর বা বিছানায় শখ করে বিছানো হয় যে কাঁথা তার নাম ‘পাড়নী কাঁথা’।


এ ছাড়াও নকশি আসন, নকশি জায়নামাজ, নকশি দস্তরখানা, বর আসন, কনের আসন, বালিশের আবরণী, আয়না-চিরুনী/পান সুপারী রাখার জন্য আরশীলতা বা বটুয়া ইত্যাদি শ্রেণির কাঁথা তৈরি হয়ে থাকে। গুরুসদয় দত্ত, জসীমউদদীন, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ লেখক-গবেষক এই সব কাঁথার নানা ধরনের শ্রেণিকরণ ও নামকরণের উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রদত্ত তথ্যের ভেতর কিছু ভিন্নতা আছে। এখানে আমাদের শুধু এইটুকু জানলেই চলবে যে, এই সব নামকরণ/শ্রেণিকরণ হয়েছে আঞ্চলিকভাবে সংগৃহীত নামের ভিত্তিতে। তাদের বর্ণিত কাঁথার নামের ভিন্নতা থাকলেও ব্যবহারিক দিক দিয়ে পার্থক্য সামান্যই।

কাঁথার আয়তনের কোনো নির্দিষ্ট মাপ নেই। প্রয়োজন মতো ছোট-বড় হতে পারে। আর কাঁথায় ব্যবহৃত মোটিফের কোনো পরিসীমা নেই। নকশিকাঁথায় নানা ধরনের বিচিত্র মোটিফ ব্যবহৃত হয়। আর এই মোটিফ কাঁথার চিত্র বিন্যাসেও বিশেষজ্ঞরা বিশেষ একটি পরিকল্পনা লক্ষ্য করেছেন। তাদের মতে, কাঁথার কেন্দ্রস্থলে থাকে পদ্ম। বাকি জমিন থাকে চার ভাগে বিভক্ত। গুরুসদয় দত্ত কেন্দ্রস্থলকে বলেন ‘পদ্মমণ্ডল’। এর পাশে থাকে শঙ্খলতার ও কলস লতার চক্র। এই কেন্দ্রমণ্ডল আরেকটি অন্তঃপুরের শিল্প আল্পনার চিত্ররীতির দ্বারা প্রভাবিত। এ পদ্ম হুবহু পদ্মের আকৃতিতে আঁকা নয়। রীতিবদ্ধ বা স্টাইলাইজড এ পদ্ম শতদল বা সহস্রদল পদ্ম।

ড. দীনেশচন্দ্র সেন একে বলেন, ‘মানস পদ্ম’। নকশিকাঁথায় সচরাচর পদ্মকে সৃষ্টির প্রাথমিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর চারটি মণ্ডলের চার কোণ থেকে প্রসারিত হয়ে আসে লতাপাতা, গাছ ইত্যাদি। চারটে দিকের নির্দেশনা থাকে তাতে। আর বিস্তৃত জমিনে ছড়ানো থাকে শিল্পীর মন মতো বিভিন্ন মোটিফ। যেমন- সূর্য, চন্দ্র, তারা, মানুষ, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, পাখি, নৌকা, মাছ, পালকি, রথ, ফল-ফুল, পাতা, আয়না, চিরুনি, চক্র, ত্রিভুজ ইত্যাদি। গুরুসদয় দত্তের মতে, এই কেন্দ্রীভূত পদ্মমণ্ডল ও তার পাশে মানুষ ও পশুপাখির সমাহার- জীবন ও আধ্যাত্মিক জগতের একটা ইঙ্গিত বহন করে। আসলে ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি, যা কোনো না কোনোভাবে গ্রামীণ জীবনে রেখাপাত করে তা উঠে এসেছে কাঁথার নকশায়।
 
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই কমবেশি নকশিকাঁথা তৈরি হলেও নকশিকাঁথার বিবরণ দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা মূলত তিনটি অঞ্চলকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো ফরিদপুর-যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চল, রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল এবং জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চল। এই তিনটি অঞ্চলের নকশিকাঁথারই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যশোর-কুষ্টিয়ার কাঁথা নকশার নিরিখে সর্বোৎকৃষ্ট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের কাঁথা সবচেয়ে পুরু- যার মধ্যে আছে লহরী কাঁথা।

এ ছাড়াও এখান থেকে আসে সুজনী- যা নতুন লালসালু দিয়ে তৈরি হয়। জামালপুর-ময়মনসিংহ থেকে আসে আরেক ধরনের কাঁথা-যার মধ্যে সূক্ষ্ম ফোঁড়ের কাজ করা পাইড় বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
 
নকশিকাঁথায় যেসব পাইড় ব্যবহৃত হয় তার কয়েকটির নামও এখানে উল্লিখিত হলো : মেফুর, লতা, নয়চিড়ে, ঝাপ দালান, মাদার কাঁটা, কাজল লতা, শ্যাম লতা, বুতাম দাগা, ফল ধাগা, সবুর দানা, টিক্কা ধাগ, পাচিশ্যাম লতা, চির দালান, মাদার কাঁটা, কাজল লতা, বুবাস দাগা, আট কোঠা, ষোল কোটা, পান পাতা, মাছ কাটা, ঘটলতা, আট পাতা ফুল, মাছের আঁশ, উচ্ছে, মোচড়া, গেলিক ধাঁন্দা, জোড় কাকড়া, চুড়ি ধাপা, জাল ফাঁস, চাড়িকান্দা, বেঞ্চি পাইড়, গোঠ সাল, দরমা, নখখুটে, নারিকেল পাতা, কলকা সংকলতা, জোড় ফাসলা, কাইচা ধাগা, মুসুরী, বাদুড় চাড়া ইত্যাদি। উল্লেখ করা যেতে পারে অঞ্চলভেদে এইসব পাইড়ের নামের ভিন্নতা আছে।

নকশিকাঁথায় সাদা জমিনের ভেতর লাল, কালো, হলুদ ও নীল রঙের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। পুরানো কাপড় অনেক বার কাচার ফলে রঙ স্থায়ী হয় এবং তার চাকচিক্য কমে গিয়ে রুচিসম্মতভাবে চাপা হয়। লোকায়ত ধারার নকশিকাঁথা সেই জন্য একই সঙ্গে যেমন দৃষ্টিনন্দন হয়, তেমনি আভিজাত্য ও রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে। গ্রামীণ নারীরা তাদের কাজের অবসরে দিনের পর দিন সুঁই-সুতোর ফোঁড়ে ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তোলে তাদের জীবনসম্পৃক্ত নানা বিষয় বিভিন্ন প্রতীক ও রূপকের আড়ালে। নকশিকাঁথা বাংলাদেশের লোকায়ত ধারার শিল্পীদের সৃজনশীলতা ও উন্নত রুচির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
 
তবে সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, লোকায়ত ধারায় এই শিল্পকর্মের মধ্যেও নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। ঐতিহাসিক সত্য এই যে, সাধারণভাবে গ্রামের মেয়েরা নকশিকাঁথা তৈরি করে থাকতো নিজেদের ব্যবহারের জন্য। কখনো কখনো তারা এটা উপহারও দিয়ে থাকে প্রিয়জনদের। এর মধ্যে কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে দেশীয় এলিট শ্রেণির মধ্যে দেশীয় হস্তশিল্পজাত দ্রব্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং তারা দেশীয় সংস্কৃতির পরিচয়বাহী এই সব লোকায়ত সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে নিজেদের ড্রইং রুমে প্রদর্শন করতে শুরু করে- যার একটি হলো নকশিকাঁথা।


এভাবে, গ্রামীণ মানুষের ব্যবহার্য বস্তু গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে জায়গা পায় শহরের ছিমছাম অভিজাত বাড়ির বিছানায় বা দেয়ালে। তাদের আগ্রহ ও চাহিদা মেটানোর জন্য রাজধানীতে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি বিপণি বিতান। আর এইসব বিপণি বিতানগুলো নাগরিক মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নকশিকাঁথা সংগ্রহ শুরু করে। মফস্বল ও গ্রামের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি অংশ এই চাহিদা মেটানোর জন্য স্থানীয় মহিলাদের দিয়ে অর্ডারের ভিত্তিতে নকশিকাঁথা তৈরি করতে শুরু করে।

এভাবে গ্রামের মহিলাদের অর্থ-উপার্জনের একটা পথ খুলে গেলেও (যদিও পারিশ্রমিকের পরিমাণ অত্যন্ত কম) ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা তৈরির ধারা। সুপ্রাচীন কাল থেকে নকশিকাঁথার ডিজাইন গ্রামের মেয়েরা নিজেরাই করত; কিন্তু এই পর্যায়ে, নাগরিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে, নকশা আসতে থাকে বাইরে থেকে। সে নকশা পাকা শিল্পীর হাতে আনাড়িপনা করে আঁকা। ফলত তা মৌলিকত্ব হারায়।

এমনকী কানাডা, ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে আনা ক্যাটালগের ছবির অনুকরণে নকশিকাঁথা উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়েছে- এমন তথ্যও জানা যায়। প্রকৃত বা ঐতিহ্যবাহী রীতির প্রাচীন নকশিকাঁথার সন্ধান পাওয়া এখন দুরূহ। তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত নকশিকাঁথা সহজেই পাওয়া যায়। সেই সব নকশিকাঁথায় চাকচিক্য থাকলেও-নেই আন্তরিকতা ও ভালোবাসার পরশ। তবে আশার কথা এই যে, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে খাঁটি নকশিকাঁথা দেশে ও বিদেশে সংগৃহীত আছে। বাংলাদেশের অনবদ্য নকশিকাঁথা এদেশের নারীদের শিল্পীসত্তার এক চমৎকার প্রমাণ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //