স্মরণ

সুলতান স্মৃতি

কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাইয়ের ক্ষণজন্মা শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘সুলতান’-এ রয়েছে শিল্পীর জীবনালেখ্য এবং সৃষ্টির মূল্যায়নের অনবদ্য বিবরণ। তাতে তিনি দার্শনিক- সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি প্রবন্ধ থেকে একটি দীর্ঘ বাক্য উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে আমরা পাই শিল্পী সুলতানের অধিকাংশ চিত্রকর্মের অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় বর্ণনা।- “শেখ মুহাম্মদ সুলতানের আঁকা গুরুভার নিতম্ববিশিষ্ট পীনস্তনী এ সকল চমৎকার স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠা লীলা-চঞ্চলা নারী, স্পর্ধিত অথচ নমনীয় সর্বক্ষণ সৃজনলীলায় মত্ত অহল্যা পৃথিবীর প্রাণ জাগানিয়া, এ সকল সুঠামকান্ত কৃষাণ, এ সকল সুন্দর সূর্যোদয়, সুন্দর সূর্যাস্ত, রাজহাঁসের পাখনার মতো নরম তুলতুলে এ সকল শুভ্রশান্ত ভোর, হিংগুল বরন মেঘ-মেঘালীর অজস্র সম্ভার; প্রসারিত উদার আকাশ, অবারিত মাঠ, গগন ললাট, তাল-তমাল বৃক্ষরাজির সারি, দীঘল নদী তীরের এ সকল দৃষ্টি শোভন চর, মাঠের পর মাঠে থরে থরে ঢেউ খেলানো সোনার ধান, কলাপাতার ফাঁকে-ফাঁকে জোনাক-জ্বলা এমন মোহিনী অন্ধকার, আঁকাবাঁকা মেঠো পথের বাঁক বাঁশ-কাঠে গড়া কিষানের এ সকল সরল আটচালা, এ সকল আহ্লাদী বাছুর এবং পরিণত বয়স্ক গবাদি পশু, সর্বোপরি গোটা জনপদের জনজীবনে উৎসারিত উৎপাদন-শৃঙ্খলে আবদ্ধ সভ্যতার অভিযাত্রী অজেয় মানুষ, তারা যেন দৈনন্দিন জীবন-ধারণের স্রোতে কেলি-কলা-রসে যুগ থেকে পেরিয়ে অনন্তের পথে ভেসে যাচ্ছে, ক্যানভাসে তাদের প্রত্যয়-দীপ্ত বলিষ্ঠ উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ ঋজু গতি-ভঙ্গিমা এমনভাবে বাঁধা পড়েছে, মনে হবে সমগ্র নিসর্গ দৃশ্য ছাপিয়ে মেঘেতে ঠেকেছে তাদের মস্তক এবং পাতালে প্রবিষ্ট হয়েছে মূল, তাদের শ্রম-ঘামের ঝঙ্কার চেষ্টায় সংগীত সমস্ত প্রাকৃতিক কোলাহল ভেদ করে আকাশ-গঙ্গার কিনারে কিনারে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনিতে ফেটে পড়েছে।” বাংলা ভাষায় এই অন্যতম দীর্ঘ বাক্যটিতে সুলতানের ছবির ব্যাপকতা, তার প্রকাশের বলিষ্ঠতা, অনুভূতির গভীরতা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে জীবন্ত হয়ে। 

কিন্তু এই বর্ণনাই সম্পূর্ণ নয়। সুলতানের আরও অনেক শিল্পকর্ম আছে যেখানে বিশেষ করে বাংলা ও কাশ্মীরের নিসর্গ চিত্রায়িত হয়েছে- জলরং আছে, মিক্সড মিডিয়া আছে, তেল রং আছে। আমি শিল্পীকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ‘আপনার ছবিতে বাংলার মানুষ ও নিসর্গের প্রাধান্য বোধগম্য। কিন্তু কাশ্মীর এলো কী করে?’ তিনি বললেন- “প্রকৃতিতে সংগ্রামী মানুষই আমার মুখ্য প্রতিপাদ্য। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘কাশ্মীর’ নিয়ে দুটি কবিতা- যেখানে সেখানকার প্রকৃতির কোলে সংগ্রামী, মুক্তিকামী মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় বৈপ্লবিক চিন্তা পেয়েছে উদাত্ত উচ্চারণ- তা আমাকে উদ্বুদ্ধ, প্রাণিত করেছিল। ১৯৪৭ সনে আমি কয়েক মাস কাশ্মীরে এবং আশেপাশে কাটিয়েছি। ছবি এঁকেছি।” দুর্ভাগ্যবশত সেই সময়কার আঁকা অনেক ছবিই হারিয়ে গেছে। সুলতানের চিত্র-কর্মের উপর লেখা শিল্প সমালোচক আমজাদ আলী এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর প্রবন্ধে রয়েছে তার সপ্রশংস বর্ণনা। ১৯৪৮ সনে লাহোরের তৎকালীন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার ফিরোজ খান নূন এবং পরবর্তী সময়ে করাচিতে মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ কর্তৃক উদ্বোধিত সুলতানের দুটি চিত্রপ্রদর্শনীতে এগুলোর উদ্ধারকৃত কিছু ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। তখনই সুলতান লাভ করেন স্বীকৃতি- আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ ও প্রদর্শনী-অন্তে যা লাভ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়। বাংলায় বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু তখনো তার তেমন সুপরিচিতি নেই। বিভিন্নকালে সুলতানের চিত্রকর্ম এবং তার বিষয়বস্তু বিভিন্ন হলেও বাংলা ভাষার প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়- ‘সুলতান যদিও তার ব্যক্তিগত বিষয় চেতনা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে উড্ডীন- তার পদযুগল দৃঢ়ভাবে ভূমিলগ্ন। তিনি কখনো জীবন-বিচ্যুত হননি।’ 

দুই
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সুলতানের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা বহির্বিশ্বেই প্রথম ঘটেছে। এর অনেক পরে বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে) তিনি সুপরিচিত হলেন। প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন, ‘সুলতান ছবি এঁকেছেন, অজস্র ছবি। ছোট-বড়, প্রকৃতির, মানুষের। সিমলায় প্রদর্শনী করলেন ১৯৪৫ সালে, লাহোরে ১৯৪৮ সালে, আর করাচিতে ১৯৪৯ সালে। বেশিরভাগই বাংলা ও কাশ্মীরের নয়নাভিরাম ল্যান্ডস্কেপ, কিছুটা আদর্শায়িত। জলরঙের কাজ ও তৈলচিত্র।’ সে সময়েই কত উঁচু পর্যায়ে তিনি বিবেচিত হয়েছিলেন তা বোঝা যায়- স্বদেশ থেকে বহুদূরে 

আপাত-অপরিচিত স্থানেও তার চিত্রপ্রদর্শনীয় উদ্বোধনকারীদের পরিচিতির মাধ্যমে। সিমলাতে পাতিয়ালার মহারাজা, লাহোরে তদানীন্তন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার ফিরোজ খান নূন আর করাচিতে ফাতেমা জিন্নাহ এসব প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। এর কিছুকাল পরেই করাচি থেকেই তিনি আমেরিকাÑইউরোপ চলে যান ছবি আঁকতে, প্রদর্শনী করতে।

অথচ দেশে শিল্পী সুলতানের প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছিল অনেক পরে- ১৯৭০-এ খুলনাতে। পরে ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং এর ১০ বছর পর ১৯৮৬ সালে ঢাকায় জার্মান ইনস্টিটিউটে প্রদর্শনী হয়। বাংলা ভাষায় অন্যতম কবি শামসুর রাহমানের একটি উদ্ধৃতি সুলতান পরিচয়কে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে- সুলতান বর্ণাঢ্য জীবন যাপন করে গিয়েছেন। তার এই জীবন সম্পর্কে বিশদ জানতে হলে সবার অবশ্যই পাঠ করতে হবে কৃতী কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা উপন্যাস ‘সুলতান’। এতে প্রকাশিত হয়েছে একজন অসামান্য শিল্পীর প্রকৃত জীবন।... গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের এক বালক লাল মিয়া কী করে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একজন অসাধারণ মানুষ এবং শিল্পীতে বিকশিত হয়ে উঠলেন তারই আখ্যান ‘সুলতান’।

সুলতানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৫৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমি যশোরে পিতার কর্মস্থলে ছুটিতে গিয়েছিলাম। বাবা গিয়াস উদ্দীন আহমদ চৌধুরী তখন বৃহত্তর যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বললেন, “জানো একজন বিশ্বখ্যাত শিল্পী এখানে থাকেন- নড়াইলে। অথচ স্থানীয়ভাবে তার পরিচিতি খুবই কম। আমি অনেক কষ্টে নড়াইলে তার গ্রাম চাচুরি-পুরুলিয়া গিয়ে তার ছবি আঁকার স্কুল ‘নন্দন কানন’ উদ্বোধন করে এসেছিলাম। আমার খুবই ভালো লেগেছিল।” সেদিন বিকেলে সুলতান আমাদের বাসায় এলেন। তার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত তখনই। এই সম্পর্ক পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। আবার সমর্থন ও সহযোগিতা সম্পর্কে সুলতান খুবই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। 

পরবর্তী দশকে সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হলেও সম্পর্কে গভীরতা ছিল। এই সম্পর্ক আরও গাঢ় হলো যখন ঘটনাচক্রে আমি তদানীন্তন বৃহত্তর যশোর জেলার ডিসি হিসেবে যোগদান করলাম ১৯৬৮ সালে; সুলতান তখন মাঝে মাঝে যশোর সদরে এলে আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন। সুলতান ছিলেন একজন অসাধারণ গুণী লোক। তিনি চমৎকার বাঁশি বাজাতেন আর কথোপকথনে ছিল তার অসাধারণ উৎকর্র্ষ। মনে পড়ে, একবার এক নৈশভোজ শেষে আপ্যায়িত অতিথিদের সঙ্গে আমরা প্রশাসক ভবনের বড় পুকুর পাড়ে বসেছিলাম। সুলতান তখন তার মোহন বাঁশির অনবদ্য সুরে আমাদের বিমুগ্ধ করে রেখেছিলেন অনেকক্ষণ।

সুলতানের স্বপ্ন ছিল, গ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত ‘নন্দন কানন’ যেন একটি উন্নতমানের চিত্রশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে, আর শিল্পীরাও যেন তাদের মেধা প্রকাশে অনুকূল পরিবেশ পায়। তখন আমরা যশোর জেলা পরিষদ এবং অন্য আরও কিছু উৎস থেকে তাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করি। তারপর আমি নিকটবর্তী খুলনা জেলার ডিসি হিসেবে যোগদান করি। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই, খুলনাতেই আমরা সুলতানের একটি বড় আকারের চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করব, যা হবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সুলতানের প্রথম আর্ট এক্সিবিশন। 

খুলনা ক্লাবেই ১৯৬৯ সালে আয়োজিত হয়েছিল এই চিত্রপ্রদর্শনী। সুলতান এটার জন্য ছোট-বড় বহু ছবি আঁকলেন। অয়েল, মিক্সড মিডিয়া, ওয়াটার কালার- প্রায় সব আঙ্গিকেই তার শিল্প শৈলীর প্রকাশ ঘটত। তার এই প্রদর্শনী নিয়ে বেশ প্রচার করা হলো। প্রদর্শনীকে সফল বলাÑই যেতে পারে। দর্শনাথীর ভিড় ছিল, আর সম্ভবত কোনো ছবিই অবিক্রীত ছিল না। তখনকার একটি ঘটনা খুব মনে পড়ছে। প্রদর্শনী চলাকালীন খুলনাতে সফরে আসলেন প্রিন্স করিম আগা খান এবং তার নবপরিণীতা স্ত্রী প্রিন্সেস সেরিনা। তাদের খুলনার ব্যস্ত কার্যক্রম ছিল। তখন খুলনাতে আগা খানের অনুসারী অনেক শিল্পোদ্যোক্তা বাস করতেন। তাদের মালিকানায় বেশ কয়টি পাটকল ছিল। তাদের খুলনায় উপকূলবর্তী ছোট দ্বীপ বা চরে আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট স্থাপনের অভিপ্রায় ছিল। এগুলোর ব্যাপারে প্রিন্সের অনুমোদন ছিল এবং সরকারের সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনাও চলছিল। এটা স্থাপিত হলে দেশের পর্যটনশিল্পে এটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটত। 

শুনেছিলাম প্রিন্স করিম এবং প্রিন্সেসের চিত্র শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। তখন খুলনায় অবস্থানরত তাদের অনুসারীদের নেতারা সুলতানের চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে আগ্রহী হলেন। একদিন প্রোগ্রাম ঠিক করা হলো সম্মানিত অতিথিরা চা-চক্রে এসে পাশে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদে লঞ্চে স্বল্পকালীন বিহারে যাবেন। তখন সুলতানের সঙ্গে আলোচনাচক্রে ঠিক করলাম ক্লাব থেকে কয়টি ছবি নিয়ে এসে বাসভবনে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হবে। অতিথিরা ছবি দেখে চা খেয়ে নৌবিহারে যাবেন। চিত্রকর্ম দেখার সময় প্রিন্সেসের একান্ত সচিব আমাকে বললেন- ছবি কেনা সম্ভব কিনা? সুলতানের সঙ্গে আলাপ করতেই তিনি বললেন, অবশ্যই সম্ভব। চুপিসারে আমি সুলতানকে বললাম প্রদর্শনীর জন্য ছবির দাম যা নির্ধারিত ছিল, তারা হয়তো তার চাইতে ও উঁচু মূল্যে কিনতে আগ্রহী হবেন। দাম জিজ্ঞেস করলে কিছুটা বাড়িয়ে বলা বা সে ধরনের ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে। 

ছবি দেখা যেন শেষই হয় না। তার সচিব এসে তাদের বাসভবনের জন্য আপতত দুটি ছবি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। তিনি পরে আরও কিছু ছবি কেনার সৌভাগ্য লাভের আশাও প্রকাশ করলেন। চা-চক্রে বসে প্রিন্সেস ছবিগুলো এবং আর্ট সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত তা এত দীর্ঘ হলো যে, প্রস্তাবিত নদ বিহার স্থগিত করতে হলো। তাদের চলে যাওয়ার পরে শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলাম- কত দামে তারা কিনলেন? 

সেটা শুনে সুলতান তাদের দেওয়া চেক দুটি খুঁজেই পাচ্ছিলেন না। পরে সেগুলো পেয়ে বললেন আমি চেকের অঙ্ক পড়ে দেখিনি। আপনি দেখেন তো কত? আমি দেখলাম, দুটি চেকেই পাঁচ লাখ টাকার অঙ্ক লেখা হয়েছে। দুটি ছবি মিলিয়ে দশ লাখ টাকা সে যুগে অবিশ্বাস্যই ছিল।

সুলতান বললেন- হ্যাঁ, প্রাইভেট সেক্রেটারি এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন খুবই বিনীতভাবে। আমি তখন কী বলব, ঠিক ভেবে না পেয়ে পাঁচ হাজার বলতে গিয়ে পাঁচ শব্দটিতেই আটকে গেলাম। ছবির সর্বোচ্চ মূল্য তখন সম্ভবত দুই-তিন হাজার রুপি। পাঁচ শুনেই সচিব বলে উঠলেন-‘থ্যাংকস। ঠিক হ্যায়। গ্রেটফুল।’ তারপর এই চেক দুটি এসে দিয়ে গেলেন। পাঁচ বলতে সম্ভবত সচিব পাঁচ লাখ টাকা মনে করেছিলেন। অবশ্য তিনি বলেছিলেন- এসব ছবির দাম অমূল্য।

আগা খানের কয়েকজন অনুসারী আরও কয়েকটি ছবি নিজেদের জন্য কিনেছিলেন। প্রিন্সেস নিজে এসে শিল্পী সুলতানকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিলেন। সচিবেরই অনুরোধে ছবি দুটি খুলনা-যশোর সীমান্তবর্তী আগা খানের মালিকানাধীন নওয়াপাড়া জুট মিলের ম্যানেজারের কাছে রক্ষিত থাকল। 

একান্ত সচিব বললেন- প্যারিসে তাদের নিজস্ব ভবনে ছবি দুটি নেওয়া হবে। শিল্পী সুলতানের টাকা-পয়সা, পার্থিব কোনো সামগ্রী বা সঞ্চয়ের কোনো আগ্রহ কোনোকালেই ছিল না। হাতে কিছু টাকা পেলেই তিনি সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তার এই অভ্যাসবোধ রোধ করা অসম্ভব ছিল। তাই স্থির করা হলো, ইদানীংকালে সুলতানের যে প্রচুর অর্থ হয়েছে তা এবার ব্যাংকে তার নামেই জমা থাকবে। তবে চেক ভাঙানোর ‘জয়েন্ট সিগনেটারি’ থাকবেন নড়াইলের মহকুমা হাকিম। তাতে যদি কিছুটা রাশ টেনে রাখা যায়। কিছুদিন পরেই সেখানকার এসডিও সিন্ধু প্রদেশের শওকত আলি (সিএসপি) গলদঘর্ম হয়ে জানালেন- আমি এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাচ্ছি। রাত নেই দিন নেই, সইয়ের জন্য আমার কাছে প্রার্থীদের প্রসেশন লেগেই আছে। আমি জিজ্ঞেস করলেই শিল্পী রেগে যান, টাকা তো দেওয়ার জন্যই। আমার টাকা আমি দিচ্ছি, অসুবিধা কোথায়?

যা হোক, মহকুমা হাকিমকে এই নিগ্রহ থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও সুলতানের টাকা খরচ হতে বেশিদিন লাগল না। 

তিন
সুলতান সম্পর্কে বিস্তারিত একজন ইতালীয় আর্ট ক্রিটিক মারিও পালমা তার বই ‘টেলস অব অ্যান আর্ট লাভার’-এ উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য ঢাকাতে ইতালির রাষ্ট্রদূত হিসেবে গত দশকের শেষার্ধে নিযুক্ত ছিলেন। একজন পেশাদার কূটনীতিক হলেও তিনি প্রকৃত শিল্পযোদ্ধা ছিলেন এবং আর্ট সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। আত্মজীবনীভিত্তিক ‘টেলস অব অ্যান আর্ট লাভার’ বইয়ে তিনি বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন এবং বিভিন্ন শিল্পীর সৃষ্টি সম্পর্কে উঁচু ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তবে এর মধ্যে তিনি শিল্পী সুলতানকে অত্যন্ত উচ্চাসনে স্থান দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘S M Sultan is the greatest interpreter of the soil and spirit of Bangladesh, both is vision and style neither old fashioned nor naive.’ তিনি লিখেছেন, সুলতানের চিত্রকর্ম ক্লাসিক হয়েও ‘extra-ordinarily topical.’ সুলতানকে তিনি একজন বিশ্বসেরা চিত্রশিল্পী জ্ঞান করে তার বইতে লিখেছেন, ‘The depiction of strong male and female physique, so peculiar in Michelangelo, frescos is to be found also in Sultan.’ এসব সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে দেখার ক্ষমতাই সুলতানের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষে ডিরেক্টর পিটার জেভিটস বলেছিলেন, “এই উপমহাদেশের গুটিকয়েক অসামান্য শিল্পীর মধ্যে সবচেয়ে জমকালো সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর। সুলতানের শক্তির উৎস তার টিকে থাকা ক্ষমতায়। যেসব মানবমূর্তি তিনি এঁকে রচনা করেছেন, সেসব জীবনযুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার বার্তাবহ।” 

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুলতানের অতীব সম্মানজনক স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আর স্বদেশে কিছুটা দেরিতে হলেও তিনি পেয়েছিলেন অসামান্য সম্মান, প্রীতি ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। সম্ভবত এ দেশের কোনো শিল্পীই দেশে-বিদেশে এমন আলোচিত, প্রশংসিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হননি। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, “সুলতান তাহলে কী? একজন লুকানো পিকাসো? একজন গোপন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ? সুলতান দুই-ই। খুব সম্ভব আরও।’

শিল্পী সুলতানের সাহচর্য ও সখ্য আমার জীবনের একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে জ্ঞান করি। তার একটি আশ্চর্য সুন্দর সম্মোহনী আকর্ষণ সবাইকে টেনে নিয়ে যেত তার কাছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার ছবি সসম্মানে সংগৃহীত হতে দেখছি। জীবনের শুরু থেকেই আন্তরিক শুভেচ্ছা সহযোগিতা পেয়েছেন সবার কাছ থেকে। আর সুলতান তা সব সময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। তার প্রথম দিককার জীবনে আমার বাবা প্রয়াত গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর আন্তরিক সহযোগিতা ও সমর্থন স্মরণকৃত শিল্পীর বক্তব্য হাসনাত আবদুল হাইয়ের বইতে পাওয়া যায়। ‘সুলতান বললেন, মহাপুরুষের মতো মানুষ ছিলেন তিনি। খুব বিবেচক। ওই বলে এসেছিলাম, গরীব মানুষ। গ্রামের লোকজন যতœআত্তি করতে পারবে না মনে রেখে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সবকিছু। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। পুরোনো মুরব্বিরা জানতেন কখন কার সঙ্গে কী করতে হয়। জাত-পাত-ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। বলতে বলতে তিনি উদাস হয়ে যান।’

সারা বিশ্বজুড়েই ছিল (এবং আছে) সুলতানের গুণমুগ্ধ ও শিল্পকর্মে মোহিত অসংখ্য মানুষ। সুলতানের সঙ্গে আমি বহু জায়গায় একসঙ্গে গিয়েছি, আলাপ-আলোচনায় সময় কাটিয়েছি। সে সান্নিধ্য ভুলবার নয়। এত স্মৃতি রয়েছে যে সেগুলো সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যক্ত করাও সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি, জীবনের যাত্রাপথে সুলতানের সঙ্গে পরিচিতি ও সখ্য যতই বেড়েছে, যতই তাকে দেখেছি, চিনেছি, আবিষ্কার করেছি, তার প্রতি শ্রদ্ধা, প্রীতি, সৌহার্দ্য ধারণা- সবই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। জীবন সায়াহ্নে এসে পেছনের দিকে তাকালে দেখি, আমার জীবনের পটভূমে সুলতান পূর্ণ আলোকে দেদীপ্যমান।

লেখক: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সচিব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //