হংকং প্রশ্নে গভীর হচ্ছে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব

গত ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক বার্তায় ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে হংকং আর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নয়। মার্কিন কংগ্রেসকেও তিনি এই কথাই বলে এসেছেন। 

পম্পেওর এই ঘোষণা ছিল চীনা সরকারের হংকংয়ের জন্য নতুন নিরাপত্তা আইন তৈরির পদক্ষেপের ফলাফল। 

পম্পেও আরো বলেন যে, এটা এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, হংকংকে চীন নিজের মতো করে গড়ে নিতে চাইছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়ে বিবিসি জানায়, এতকাল বৈশ্বিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে হংকংকে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে আসছিল। তবে এই নতুন আইনের কারণে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন ব্যাহত হবে। তাই হংকংয়ের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটি এখন রহিত করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। 

আইনগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র হংকংকে এই সুবিধা দিচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সময় থেকেই। তবে ২০১৯ সাল থেকে এই আইনগত সুবিধা হংকং পাবে কিনা, তা নির্ভর করছিল হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এই সময় থেকেই হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনকে যুক্তরাষ্ট্র স্বায়ত্তশাসন আখ্যা দেবে কিনা, তা হয়ে গিয়েছিল শর্তসাপেক্ষ। 

যদি মার্কিন সরকার কংগ্রেসকে বোঝাতে না পারে যে, হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন এখনো বলবত রয়েছে, তাহলে কংগ্রেস হংকংয়ের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিতে পারে। এর অর্থ হলো- এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র হংকং এবং চীনের মাঝে কোনো পার্থক্য করবে না। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকংয়ের কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে; সেখানে বিনিয়োগও ব্যাহত হতে পারে। হংকংকে চীনা ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার জন্য।

অপরদিকে চীনা সরকার বলছে, নতুন আইনের মাধ্যমে হংকংয়ে সহিংসতা বন্ধ করা যাবে। এতে শুধু কিছু সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিই বিপদে পড়বে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ থেকে চীনাদের অধীনে যাওয়ার সময় চীনারা ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’র অধীনে হংকংকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। 

তবে হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা বলছে, নতুন আইনের মাধ্যমে চীন হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিতে চাইছে। আন্দোলনকারীদের নেতা জশুয়া ওয়ং বলেন, চীনের নিরাপত্তা আইন হংকংয়ের ব্যবসার ব্যাপক ক্ষতি করবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার নেতাদের হংকংয়ের সাথে ব্যবসার জন্য বিশেষ সুবিধা বাতিলের আহ্বান জানান। হংকংয়ের বিশেষ স্ট্যাটাস ধরে রাখার মাধ্যমেই ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন বলে জানান তিনি। 

নিজেদের কূটনৈতিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হংকংয়ে মার্কিন সরকারের মালিকানায় থাকা ৬৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত ব্রিটেন ও কমনওয়েলথের অন্তর্গত কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া চীনা পদক্ষেপের ব্যাপারে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছে। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি এখনো দেয়নি। ব্রিটেন বলছে, তারা হয়তো হংকংয়ের বাসিন্দাদের জন্য ভিসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারে। 

হংকংয়ের বিশেষ স্ট্যাটাস চলে যাওয়ার সম্ভাবনার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বিবিসি জানায়, এর অর্থনৈতিক ফলাফলের চেয়ে ভূরাজনৈতিক ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন কিছু করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য, মহামারি ও প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে রয়েছে। 

এখন প্রশ্ন আসবে, হংকংয়ের বিশেষ স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়ার ফলে হংকংবাসীর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা হবে কিনা; অথবা এতে শুধু হংকংয়ের জনগণের কষ্টই আরো বাড়বে কিনা। 

২৯ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, হংকংয়ের বিশেষ স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র কিছু গুরুত্বপূর্ণ চীনা ব্যক্তির ওপর অবরোধ আরোপ করতে পারে। 

রয়টার্স জানায়, ৩১ মে চীনা মিডিয়াতে মার্কিন ঘোষণার ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপলস ডেইলিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত চীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস বলছে, চীন ইতোমধ্যেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে যতদূরই এগিয়ে যাক না কেন, চীন প্রতিযোগিতায় থাকবে।

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠছে, তখন দুই দেশের দ্বন্দ্বে নতুন নতুন ক্ষেত্র সামনে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত কয়েক হাজার চীনা গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে সেখান থেকে বের করে দেয়া হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের মাঝে কেউ যদি এমন কোনো চীনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসে থাকে, যার চীনা সামরিক বাহিনী বা চীনা ইন্টেলিজেন্সের সাথে যোগাযোগ রয়েছে, তাহলে ওই শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল হয়ে যেতে পারে। মার্কিন কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের বিরোধী; কারণ চীনা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড়সড় আয়ের উৎস। আলজাজিরা জানায়, ২০১৮ সালে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি চীনা শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। চীনা শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা মোট বিদেশি শিক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশ। 

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব শিক্ষার্থীর গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডে জড়ানোর সম্ভাবনা বেশি, শুধু তাদেরই বের করে দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। হংকংয়ের আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করার এই পদক্ষেপ চীনা সরকারকে প্রতিশোধমূলক কোনো পদক্ষেপে প্ররোচিত করতে পারে। 

রাষ্ট্রীয়ভাবে মার্কিন-চীন দূরত্ব বৃদ্ধি এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দ্রুত কমছে ও একইসাথে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমনের কিছু প্রচেষ্টা চললেও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দেশ সাংঘর্ষিক অবস্থানেই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষুন্ন হওয়া ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন শক্তির আবির্ভাবের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। 

আর চীনের সাথে বিরোধের জের ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়ার কারণে এসব সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, যা বৈশ্বিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //