শিনজো আবের পদত্যাগে কার লাভ, কার ক্ষতি

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান; যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই যার অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বে দেশটির অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল ছিল। সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। 

আট বছর ধরে জাপানকে নেতৃত্ব দেয়া আবের পদত্যাগ শুধু জাপানের ক্ষেত্রেই নয়, ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বহু বছর ধরে পরীক্ষিত মিত্র সরে যাওয়ায় এখন যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে জাপানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ছিল চীনের মাথাব্যথার কারণ। আবের পদত্যাগ তাই চীনকেও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।

গত ২৮ আগস্ট স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আবে বলেন, ‘১৩ বছর আগে আলসারেটিভ কোলাইটিস ধরা পড়েছিল। ওই সময় নতুন উদ্ভাবিত এক ওষুধে আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। এরপর গত আট বছর ধরে আমি এই অসুস্থতা ভালোভাবেই মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গত জুনে আমার শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি হয়। আমি মনোবল হারিয়ে ফেলি।’

এক সপ্তাহের মধ্যে দু’বার হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই আবের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। এই পদত্যাগের পর নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দলের ভেতরে ভোট হবে। এরপর নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য পার্লামেন্টে ভোট হবে। ওই ভোটে বিজয়ী নেতা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকবেন। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত আবে ও তার মন্ত্রিসভা সরকার পরিচালনা করবে। নতুন কোনো নীতি গ্রহণ করতে পারবে না এই সরকার। 

জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী তারো আসো। তিনি বর্তমানে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। আবে নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রথম সারির নেতা তিনি। আবে পদত্যাগ করায় এলডিপির নেতাকর্মীরা তারো আসোকে অস্থায়ী দলীয়প্রধান হিসেবে বেছে নিতে পারেন। আরো রয়েছেন দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী, এলডিপির নেতা ও আবের সমালোচক শিগেরু ইশিবা। পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে সমর্থন কম হলেও, সাধারণ সদস্যদের মধ্যে তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। 

আবে ১৯৫৪ সালে জাপানের রাজধানী টোকিওতে এক সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আবের জন্মের তিন বছর পরই তার নানা নবুসিকি কিশি জাপানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার বাবা ও দাদারও জাপানের রাজনীতি ও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ আধিপত্য ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করা আবে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৯ সালে দেশে ফিরে জাপানের বিখ্যাত কোবে স্টিলে চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিন বছর পর চাকরি ছেড়ে তিনি তৎকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যনির্বাহী সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো এলডিপির পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে দলীয় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান। সে বছরই তিনি প্রথমবারের মতো জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে এলডিপি জয়ী হওয়ার পর ফের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন আবে। এরপর টানা আট বছর জাপানকে নেতৃত্ব দেন। 

রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত আবে তার প্রবর্তিত আর্থিক নীতির জন্য উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বে পরিণত হন। এটি আবেতত্ত্ব বা আবেনোমিকস নামে পরিচিতি পায়, যা ২০১২ সালের জাপানি সাধারণ নির্বাচনে আবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রবর্তিত হয়। এই তত্ত্বের তিনটি মূল লক্ষ্য হলো- মুদ্রানীতি শিথিলকরণ, রাজস্ব নীতির সংস্কার ও কাঠামোগত সংস্কার। 

বিশেষজ্ঞরা এই ব্যবস্থাকে ‘মুদ্রাস্ফীতি, সরকারি ব্যয় ও প্রবৃদ্ধির কৌশলের মেলবন্ধন’ বলে অভিহিত করেছেন। আবেতত্ত্বের নির্দিষ্ট নীতিগুলো হলো- মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশে রাখা, ইয়েনের অত্যধিক উপচয় সংশোধন, ঋণাত্মক সুদের হার ধার্যকরণ, দ্রুত সম্পদের পরিমাণ শিথিলকরণ, সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যাংক অব জাপান কর্তৃক বন্ড ক্রয় এবং ব্যাংক অব জাপান আইন সংশোধন। 

আবেতত্ত্ব গ্রহণের পরপরই জাপানের বিভিন্ন আর্থিক বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ নীতির কারণে জাপানি ইয়েনের দরপতন হয় ও টপিকস স্টক মার্কেট ইনডেক্সে ২২ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পায়। বেকারত্বের হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসে।

আবের শাসনামলে জাপানের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হয়েছে ও সামরিক ব্যয় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। তবে তিনি সংবিধানের ৯ ধারা সংশোধন করতে পারেননি। ওই ধারা অনুযায়ী, জাপানের কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী থাকতে পারবে না। দেশের নিরাপত্তার জন্য যে বাহিনীটি থাকবে, সেটি হলো আত্মরক্ষা বাহিনী বা সেলফ ডিফেন্স ফোর্স (এসডিএফ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপানে যে সংবিধান প্রবর্তিত হয়, সেখানে ওই ধারাটি সংযোজিত হয়। 

তবে সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারলেও, আবে মিত্র দেশের সেনাবাহিনীর সাথে মহড়া দেয়ার ক্ষেত্রে এসডিএফের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়েছেন। জাপানি কোম্পানিগুলোকে সমরাস্ত্র উৎপাদন করার সুযোগ দিয়েছেন। গঠন করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল। শিগগিরই জাপানের হাতে আসছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ধারণে সক্ষম এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার। প্রতিরক্ষা খাতে এই বিনিয়োগ চীনের জন্য নিশ্চিতভাবেই মাথাব্যথার কারণ, যেখানে একাধিক দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথেও জাপানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন আবে। সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে। এমনকি তাইওয়ানের সাথেও আবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। এর পেছনে মূল কারণ হলো- বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের উত্থান। চীন একইসাথে জাপানের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি। 

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ক্ষমতায় আসেন, দ্বিতীয় মেয়াদে শিনজো আবে প্রায় একই সময়কালে ক্ষমতায় আসেন। শি জিনপিং যেখানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প সামনে নিয়ে আসেন; সেখানে আবে তার আর্থিক সংস্কারের তত্ত্ব সামনে আনার সাথে সাথে সামরিক ও পররাষ্ট্রনীতিও শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে আবের বার্তা ছিল- জাপানই এমন এক দেশ, যা চীনা পণ্যে পরিচালিত নয়, যার সাথে নিশ্চিন্তে বাণিজ্য করা যায়, যে দেশ অন্যদের বিষয়ে নাক গলায় না।

আবের নীতির প্রধান ভিত্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মিত্রতা। প্রধানমন্ত্রী আবের শাসনামলে ২০১৬ সালের ২৬ মে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হিরোশিমা সফরে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিই হিরোশিমা সফরে যাওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট। জাতীয়তাবাদী তকমা থাকলেও আবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরেন। তিনি জানেন, জাপানের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ওয়াশিংটনের সহযোগিতা আবশ্যক। এর সাথে আরো জড়িত চীনকে মোকাবেলা ও উত্তর কোরিয়া থেকে জাপানকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে করা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও যেন ট্রাম্প জাপানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অটুট রাখেন, সেটিও নিশ্চিত করেছেন আবে। তবে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল আবের মতো এক পরীক্ষিত মিত্রের দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন থাকা। 

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সমন্বয়ের অভাবে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী। তবে এ মুহূর্তে দেশটিতে তার জনপ্রিয়তার ধারে কাছেও কোনো নেতৃত্ব নেই। আরেকজন আবে খুঁজে পাওয়াটা মার্কিনিদের জন্য মোটেও সহজ হবে না। আবের স্থলাভিষিক্ত যেই হোক না কেন, তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে এখনই গড়ে উঠছে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এটি চীন ও উত্তর কোরিয়ার জন্য নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক অবস্থা। নতুন নেতার সাথে চীন সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা যে করবে, সেটিও নিশ্চিত করেই বলা যায়। 

জাপানের শক্তিশালী নেতৃত্ব না থাকলে আবের পদত্যাগ চীনের জন্য ‘শাপে বর’ হয়ে উঠতে পারে। অপরদিকে, আবের পদত্যাগ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য নতুন সংকট হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //