বিশ্ব নেতা হয়ে উঠতে চীনের সামনে দুই পথ

বিশ্বে এখন পর্যন্ত এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশটিই এখন বিশ্ব নেতা। এখন চীনও নিজেদের এ ভূমিকায় নিয়ে আসতে চায়। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এরইমধ্যে পরাশক্তি হয়ে ওঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। 

মাত্র কয়েক বছর আগেও অনেক মার্কিন পর্যবেক্ষকের ধারণা ছিল- উদার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুধু একটি পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকায় থাকবে চীন। অথবা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে বড়জোর একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে বেইজিং। 

প্রচলিত আরো ধারণা রয়েছে- চীন শুধু আঞ্চলিকভাবে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায় এবং সেক্ষেত্রে এসব অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কিছুটা হ্রাস পাবে। যেখানে বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হয়ে ওঠার কোনো লক্ষ্য ছিল না চীনের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের জায়গা নিতে চীন প্রতিযোগিতায় নামতে যাচ্ছে- এমন লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়েই চীনের বর্তমান সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দুটি পথ ধরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে চীনের।

দেশকে বিশ্ব নেতার ভূমিকায় পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পক্ষ থেকে প্রথম ঘোষণাটি আসে ২০১৭ সালে। সে সময় তিনি বলেন, চীন একটি ‘নতুন যুগে’ প্রবেশ করেছে এবং তারা অবশ্যই ‘বিশ্বে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকবে’। এর দুই বছর পর ওয়াশিংটনের সাথে বেইজিংয়ের নাজুক সম্পর্ক বোঝাতে প্রেসিডেন্ট শি ‘নিউ লং মার্চ’ আইডিয়াকে ব্যবহার করেন।

শুধু তা-ই নয়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল- এ চার বছরের মধ্যে জার্মানি, ভারত, স্পেন ও ব্রিটেনের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি জাহাজ সমুদ্রে ভাসিয়েছে চীন। এছাড়া ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে নিজেদের অগ্রাধিকার ধরে রাখতে উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে দেশটি। উপকূলবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তারা। এশিয়া-ভূমধ্যসাগরসহ অন্যান্য অঞ্চলেও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। 

তবে বিশ্বে পরাশক্তিধর হয়ে ওঠার লক্ষ্যে চীন দুটি পথে চেষ্টা করতে পারে। প্রথমটি হলো- যুক্তরাষ্ট্র ঘরানার কৌশল। এই পথটি চীনের আশপাশ, বিশেষ করে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ, নিজ অঞ্চলে আধিপত্য অর্জন করে এরপর ধীরে ধীরে এগোতে হবে দেশটিকে; যেমনটি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় পথটি প্রথমটির তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। কারণ এ পথে কৌশলগত ঐতিহাসিক আইন-কানুন ও ভূরাজনীতিকে তোয়াক্কা করা হবে না। এক্ষেত্রে চীনকে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অপ্রতিরোধ্য শক্তিমত্তার অবস্থান তৈরিতে গুরুত্ব কম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের নিজেদের কাছে টানার ওপর জোর দিতে হবে। 

শুধু তা-ই নয়, চীনকে তার অবস্থান পোক্ত করতে হবে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে।

এখন প্রশ্ন হলো- চীন কোন পথ গ্রহণ করবে। নতুন প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, প্রথমে আঞ্চলিক পর্যায়ে আধিপত্য স্থাপনের পর বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে চীনকে। তবে এই আধিপত্য স্থাপনের অর্থ কোনো দেশকে জোরপূর্বক দখল নয়; শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমনটা করেছিল। অবশ্য এটা ঠিক ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনকে (জাপান থেকে তাইওয়ান ও ফিলিপাইন পর্যন্ত) ছাপিয়ে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে সবচেয়ে আধিপত্যশীল খেলোয়াড় হয়ে উঠতে হবে। 

শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভেটো দেয়ারও অধিকার অর্জন করতে হবে। এছাড়া অঞ্চলটিতে থাকা মার্কিন মিত্র জোটের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে হবে ও চীনের উপকূল থেকে মার্কিন সামরিক শক্তিকে ফেরত পাঠাতে হবে। চীন যদি এসবের কিছু করতে না পারে, তাহলে আঞ্চলিক পরিসরে নিজেকে শক্তিশালী অবস্থানে নিতে পারবে না। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনে ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও জাপানের মতো আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলোয় এখনো শক্তিশালী সামরিক অবস্থান ধরে রেখেছে ওয়াশিংটন। 

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় একটি দ্বিপক্ষীয় কমিশন পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করে, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে শক্তি বা ক্ষমতা, তা দেশটির আধিপত্যশীল আঞ্চলিক অবস্থানের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। ওই কমিশনের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, ‘বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সহনশীল ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারার অন্যতম কারণ- দেশটির স্থল সীমানায় সহজাত নিরাপত্তা বজায় রাখা। নিজেদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যদি গুরুত্ব না দিতো, তাহলে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পেত। ফলাফল হিসেবে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিতে পারত না তারা।’

চীনও যে একই ধরনের যুক্তি ধারণ করে, তা দেশটির অনেক নীতিমালাতেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আকাশ প্রতিরক্ষা, সাবমেরিন, এন্টি-শিপ মিসাইল প্রযুক্তিতে বিপুল পরিমাণ ব্যয় করছে চীন। নিজেদের উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে মার্কিন জাহাজ ও বিমান সরিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা সহজ করতেই এ পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। দক্ষিণ চীন সাগর ও পশ্চিম চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং। 

আবার সামরিক সহযোগী ও ব্যবসায়িক মিত্রদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দুর্বল করতে জবরদস্তি, প্ররোচনা ও রাজনৈতিক কারসাজির মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে চীন। এরইমধ্যে চীনা কর্মকর্তারা ‘এশিয়ানদের জন্য এশিয়া’ এই স্লোগান বাস্তবায়নে মনোযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ, এ অঞ্চলে কোনো সমস্যা হলে, তা নিজেরাই সমাধান করবে- সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মধ্যস্ততা থাকবে না। এছাড়া তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনতে সামরিক শক্তিও বাড়িয়ে চলেছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। আর এটি সম্ভব হলে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নের মুখে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্র চীনের আঞ্চলিক মিত্র জাপানের মুখোমুখি হয়নি। এছাড়া ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও অন্য অনেক দেশের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদ হয়নি। তবে স্থল ও সমুদ্রের সীমানা নিয়ে চীনকে অনেক সময়ই এসব দেশের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আঞ্চলিক আধিপত্য পেতে কৌশলগত প্রতিযোগিতার দিকে গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। উচ্চপ্রযুক্তি সম্পন্ন সামরিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে থেকেছে ও খুব সহজেই চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে বশ করতে পেরেছে তারা। থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের ভূরাজনৈতিক ঝোঁক পরিবর্তনের মাধ্যমে চীনের প্রলোভন ও জবরদস্তির কৌশল আংশিক সফলতা পেয়েছে। 

তবে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে একই কৌশল প্রয়োগ করতে চাইলেও চীনকে পিছু হটতে হয়েছে। ফলে বৈশ্বিকভাবে পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে আঞ্চলিক পর্যায়ে চীন সফল হতে পারবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এখন থাকল দ্বিতীয় পথ। এখানে চীনকে পশ্চিমের পরিবর্তে পূর্বের দিকে বেশি ধাবিত হতে হবে। ইউরোশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ও ভারত মহাসাগর পর্যন্ত চীনকে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতে হবে। এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিতাড়িত করা অথবা মার্কিন নৌবাহিনী থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলমুক্ত করতে পারবে না- চীনকে এমন বিষয় মেনে নিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতিমালা, প্রযুক্তির মান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে বিশ্বের পরাশক্তিধর হয়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে এখানে। 

অবশ্য এরই মধ্যে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুরু করেছে চীন। অর্থায়ন সহযোগিতার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি মহাদেশকে সংযুক্তকারী এই ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সেতু নির্মাণযজ্ঞের কেন্দ্রে অবস্থান করছে চীন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০১৭ সালের কংগ্রেসে ‘সাইবার সুপার পাওয়ার’ হয়ে ওঠার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, ডিজিটাল সিল্ক রোড তারই উন্নত রূপ। চীনা প্রযুক্তির বিকাশ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় পরিচালকের ভূমিকায় আসীন হওয়া ও চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে আসাই এই ডিজিটাল সিল্ক রোডের অন্যতম উদ্দেশ্য। 

আগ্রাসী অর্থনীতির পাশাপাশি নানারকম উদ্ভাবনে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সুবাদে কৃত্রিম মেধা থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজির মতো ভিত্তিগত প্রযুক্তিগুলোয় নেতা হয়ে উঠতে পারে চীন।

সর্বোপরি বিশ্বকে চীনের নেতৃত্বে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কিছু মতাদর্শগত প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। চীনকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা চলছে, তা শুধু অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে নয়। এসব সমস্যা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সরকারের সাথে ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী শাসকের সম্পর্ক থেকে সৃষ্ট অবিশ্বাসের প্রতিফলন। ফলে ইউরোপের অনেক দেশও আন্তর্জাতিক পরিসরে চীনের এই উত্থানকে সহজভাবে নিচ্ছে না। অবশ্য এ কারণে বেইজিং যে তার লক্ষ্য থেকে সরে আসবে তা কিন্তু নয়। তবে চীন ঠিক কোন পথ বেছে নেবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। চীনের কার্যক্রমে উভয় পথের সম্মিলিত প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। 

তবে বিশ্ব মোড়লের ভূমিকায় যেতে চীনের জন্য যে দুটি পথের কথা বলা হলো, সেখানে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা নিশ্চিতভাবেই তীব্র হচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানে অটল থাকবে নাকি চীন নেতা হয়ে উঠবে, তা দেখা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //