ককেশাসে যুদ্ধ: শান্তি প্রতিষ্ঠার দায় নেই কারও

৯ অক্টোবর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পরদিন দুপুর থেকে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মাঝে সীমিত আকারে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে চলেছে। 

এতে আরো বলা হয়, এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে মূলত মানবিক কারণে, যুদ্ধবন্দিদের আদান-প্রদান করতে, আটকেপড়া মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে ও লাশ হস্তান্তর করতে। 

রুশ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যুদ্ধবিরতির শর্তসমূহের ওপর আলাদাভাবে আলোচনা ও সমঝোতা হবে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে কত হতাহত হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত করে কেউ বলতে না পারলেও উভয় পক্ষই অপর পক্ষের ব্যাপক ক্ষতির দাবি করেছে। তবে এই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতেই প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই। 

সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র হিসেবে দুই দেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখে রাশিয়া; উভয় দেশের বেশিরভাগ অস্ত্রই সরবরাহ করেছে রাশিয়া। এছাড়াও আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তিও রয়েছে, যার শর্ত অনুযায়ী আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলে রাশিয়া সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১০ দিন আর্মেনিয়ার সাথে চুক্তির ব্যাপারে চুপ থাকার পর ৭ অক্টোবর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার চুক্তির মাঝে বিতর্কিত নাগরনো-কারাবাখ নেই, যেখানে আজারবাইজানের সাথে আর্মেনীয়দের যুদ্ধ চলছে। তিনি সহিংসতার কারণে অনেক মানুষের প্রাণহানিতে শোক প্রকাশ করে বলেন, এই যুদ্ধ যেহেতু আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে হচ্ছে না, তাই এ ব্যাপারে রাশিয়ার তেমন কিছু করার নেই। 

২৮ বছর আগে ১৯৯২ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) অধীনে ‘মিনস্ক গ্রুপ’ নামে একটা সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থার কো-চেয়ারম্যান রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় তিন দশকে এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় মিনস্ক গ্রুপের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। 

অপরদিকে তুরস্ক বর্তমান যুদ্ধের শুরু থেকেই আজারবাইজানকে সমর্থন করে আসছে; সামরিক সহায়তাও দিচ্ছে। আর গ্রুপের আরেক কো-চেয়ারম্যান ফ্রান্স ইতিমধ্যেই আর্মেনিয়ার পক্ষে কথা বলেছে ও এই বিবাদে তুরস্কের জড়ানোটা পছন্দ করেনি। নাগরনো-কারাবাখের আজারিদের নেতা তুরাল গাঞ্জালিয়েভ তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সির সাথে কথা বলতে গিয়ে মিনস্ক গ্রুপের কো-চেয়ার থেকে ফ্রান্সের অপসারণ দাবি করেন। তিনি ফ্রান্সের স্থানে তুরস্ককে কো-চেয়ারের পদে দেখতে চান বলে জানান। 

গ্রুপের অপর সদস্য যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কথাসর্বস্বই থেকেছে। এ রকম ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধ থামানোর পেছনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অভাবটুকুই সামনে আসছে বারবার। 

আলজাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ অভিযোগ করেন, মিনস্ক গ্রুপের মধ্যস্ততাকারীরা জাতিসংঘের রেজলিউশন বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো চাপ প্রয়োগ করে না। আজারবাইজান এই দ্বন্দ্ব নিরসনে আরো ৩০ বছর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। ১৯৮৮ সাল থেকে এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় দুই দেশের মাঝে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। তখন আর্মেনীয়রা আজারবাইজানের ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল সামরিকভাবে দখল করে নেয়। সেই যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার আজারি মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধে প্রায় ছয় হাজার আর্মেনীয়ও মৃত্যুবরণ করেন। 

১৯৯৩ সালের এপ্রিলের আগে এই যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের কোনো রেজলিউশন আসেনি। ওই বছর নিরাপত্তা পরিষদে চারটি রেজলিউশন আসলেও তা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১২ মে যখন রুশ মধ্যস্ততায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখন নাগরনো-কারাবাখের সবটুকুই আর্মেনিয়ার দখলে। শুধু তা-ই নয়, এর বাইরেও আজারবাইজানের ৯ শতাংশ এলাকা আর্মেনিয়া দখল করে নেয়। 

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার অফিসিয়াল সীমানা সোভিয়েত আমলে তৈরি; যা নিয়ে কোনো পক্ষই খুশি হতে পারেনি। জাতিসংঘ সেই সোভিয়েত সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েই ১৯৯২ সালের ২ মার্চ দুই দেশকে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়; কিন্তু গত তিন দশকে জাতিসংঘের এই সদস্যপদ দুই দেশের জন্য দিতে পারেনি শান্তি। এখানে রুশ ইচ্ছার বাস্তবায়নকেই মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। একইসাথে মিনস্ক গ্রুপের মতো একটা অন্তঃসারশূন্য সংস্থাকেও তাদের মেনে নিতে হয়েছে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে। রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ থেকে বের হতে না পারার কারণে এই সমস্যার সমাধানও সোনার হরিণ হয়েই থেকে গেছে। 

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালালে ইউরোপের সাথে আফগানিস্তানের সামরিক এয়ার করিডোর তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ গুটি হয়ে দাঁড়ায় আজারবাইজান ও জর্জিয়া। ২০০৩ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জর্জিয়া রুশ প্রভাব থেকে দূরে সরে যায়। আজারবাইজানের বাকুর তেলখনি থেকে উত্তোলিত তেল ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে রাশিয়া ও আর্মেনিয়াকে বাইপাস করে ২০০৬ সালে জর্জিয়ার মাঝ দিয়ে পাইপলাইন চালু করা হয়। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে বসলে এই পাইপলাইনের ভবিষ্যৎ হুমকির মাঝে পড়ে যায়। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আজারবাইজান তুরস্কের সাথে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ককেশাসে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারকে রাশিয়া সন্দেহের চোখেই দেখেছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে অত্র অঞ্চলে তুর্কি প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

ককেশাসে প্রভাব বিস্তার করার জন্য অনেক দেশই এগিয়ে এসেছে; কিন্তু সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেই প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসব রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আর তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘৮২২’, ‘৮৫৩’, ‘৮৭৪’ এবং ‘৮৮৪’ নম্বর রেজলিউশন অর্থহীনই রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে জড়িয়েছে দুই দেশ; শক্তিশালী দেশগুলো তাতে দিয়েছে ইন্ধন। দন্তহীন জাতিসংঘের রেজলিউশনের ব্যাপারে ভীত হওয়ার কোনো কারণই তাদের ছিল না; বরং সবাই হিসাব করেছে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি কী চায়। 

গায়ের জোরই যেখানে সমস্যা সমাধানের একমাত্র কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে রাশিয়া ছাড়াও তুরস্ক ও অন্যান্য দেশের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে; বেড়েছে লাশের মিছিল। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কদর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য আর কী প্রয়োজন?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //