মালাবারে কোয়াড মহড়া কী বার্তা দিলো

৩ নভেম্বর থেকে বঙ্গোপসাগরে শুরু হয় যৌথ নৌ-মহড়া ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’- যেখানে অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের নৌবাহিনী। মালাবারের ২৪তম এই আয়োজনে এবার যোগ দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। 

করোনাভাইরাস বাস্তবতায় মহড়ার নিয়মকানুনে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। এটি হলো প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হবে নভেম্বরের শেষে। এই মহড়ায় অংশ নিচ্ছে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘জন এস ম্যাককেইন’, অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘বালারাট’, জাপানের নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘ওনামি’, ভারতীয় নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘রণবিজয়’, ফ্রিগেট ‘শিভালিক’, সাপ্লাই জাহাজ ‘শক্তি’, সাবমেরিন ‘সিন্ধুরাজ’ ও একটা ‘পি৮আই’ এন্টিসাবমেরিন বিমান। 

মার্কিন সামরিক বাহিনীর পত্রিকা নেভি টাইমস জানায়, এই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে চীনকে টার্গেট করে। চীনকে টার্গেট করা হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনা প্রভাব মোকাবেলার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বিস্তারে ভারত যখন বিচলিত, তখন এই চার দেশের মাঝে তৈরি হয়েছে ‘কোয়াড’ নামের এক কৌশলগত জোট। 

জাপান টাইমসের এক প্রতিবেদনে ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’কে সরাসরি কোয়াডের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। কিছুদিন আগেই টোকিওতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের শীর্ষ কূটনীতিকরা বৈঠক করেছিলেন কোয়াডের অংশ হিসেবে। ওই বৈঠক থেকে বিশেষ কোনো ঘোষণা না এলেও এটিকে চীনের প্রতি হুঁশিয়ারি হিসেবেই দেখা হচ্ছে। 

যদিও এই মহড়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোয়াডের অংশ বলে ঘোষণা দেয়া হয়নি, তবুও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মহড়া মূলত ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাবকে মোকাবেলার উদ্দেশ্যেই আয়োজন করা হয়েছে। পরে এই মহড়াকে হয়তো কোয়াডের অংশ বলেই ঘোষণা দেয়া হবে। 

এই মহড়ায় ১৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া অংশ নিচ্ছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস এক বার্তায় বলেন, ‘এই মহড়ার মাধ্যমে ভারতের সামরিক বাহিনীর সাথে অস্ট্রেলিয়ার আস্থা বৃদ্ধি পাবে।’ 

ভারতীয় পত্রিকা ইকোনমিক টাইমসও এই মহড়াকে ‘কোয়াড মালাবার’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। ভারতের জন্য এই মহড়া এমন এক সময়ে এলো, যখন চীনের সাথে হিমালয়ের পাদদেশে সংঘাতের পর ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো কার্যত ভারতকে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। উল্টো এই সময়ে চীনের সঙ্গে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে। 

ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা এমন পরিস্থিতিতে ভারতের অসহায়ত্বকে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। ভারতের দ্য প্রিন্ট পত্রিকার প্রধান সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক শেখর গুপ্ত বলেন, ‘বহুদিন ধরেই ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয়নি; আর সেই সুযোগে চীন দক্ষিণ এশিয়াতে তার অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের ঐকান্তিক সহায়তায় ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমনে বিরাট সাফল্য পেয়েছে; অথচ প্রতিদানে ভারত তার নাগরিকত্ব আইন পাস করার পর বিরাট এক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কোন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। একই সময়ে চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা দিয়েছে। এছাড়া চীনারা বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা  নেপালেও বিনিয়োগ করে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। এরই মাঝে আইএমএফের হিসাবে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি হবে বলে ঘোষণা করা হলে, অনেকেই এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মাথাপিছু আয় ভারতের কয়েক গুণ, সেটি ভারতীয়দের চিন্তার কারণ ছিল না কখনোই। অথচ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের খবর পত্রপত্রিকায় আসার সাথে সঙ্গেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ে।” 

শেখর গুপ্তের কথায় বোঝা যায় যে, ভারত সরকার বাংলাদেশকে তাদের অতি কাছের বন্ধু বললেও বাস্তবতা অতটা সহজ নয়। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ছাড়াও চীন থেকে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ব্যাপারটিও ভারত ভালো চোখে দেখে না। বিশেষ করে সাবমেরিন কেনাকে ভারতীয় চিন্তাবিদরা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। কক্সবাজারে চীনা সহায়তায় তৈরি হচ্ছে স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি। এশিয়া টাইমস জানায়, এতে ভারতের সাথে চীনের উত্তেজনা আরও উস্কে যেতে পারে।

ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা জানায়, গত আগস্টে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে নীতিগতভাবে অস্ট্রেলিয়াকে ‘মালাবার’ মহড়ায় আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখে চীনের সাথে ভারতের সংঘাত এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। মালাবার ও কোয়াডের যোগসূত্র এখানেই। 

থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের সিঙ্গাপুর অফিসের সিনিয়র ফেলো আলেক্সান্ডার নেইল বিবিসিকে বলেন, ‘কোয়াডের কর্মকাণ্ড আটকে থাকার মূল কারণ ছিল ভারত; যারা ঐতিহাসিকভাবেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ ছিল। আর এখন এই জোটের সামনে চলে আসাটাও হয়েছে ভারতের জন্যই, যারা এখন চীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে।’

অক্টোবরে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে যান। সফরকালে তারা মার্কিন ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’তে যোগ দেয়ার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান। বাংলাদেশ থেকে সরাসরিই বলে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশ কোনো নিরাপত্তা জোটে যুক্ত হবে না। আর মার্কিনিদের এই কৌশলের অধীনে বাংলাদেশ কোনো অস্ত্র কিনতেও অগ্রহী নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়। এর প্রায় দু’সপ্তাহ পরই ‘এক্সারসাইজ মালাবার’-এর তৃতীয় দিনে ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পাঁচটি জাহাজ কমিশনিং করা হয়; যার মাঝে তিনটি ছিল চীনা নির্মিত। এর আগেও ১৮ জুন হিমালয়ে ভারতের সাথে চীনের সংঘাতের চরম অবস্থায় বাংলাদেশ একটা চীনা নির্মিত কর্ভেট কমিশনিং করে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ ও ‘কোয়াড’-এর মূল লক্ষ্য হলো- ইন্দো-প্যাসিফিককে চীনা প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। এই লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে নৌ-মহড়া শুধু চীনের জন্যই নয়, চীনকে বন্ধু ভাবা যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যও বার্তা দিচ্ছে। ঘটনা প্রবাহই বলে দিচ্ছে- বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন আরো এক ধাপ এগোলো, যেখানে সামনের দিনগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি আরো বৃদ্ধি পাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //