আরসেপ বাণিজ্য চুক্তির ভূরাজনৈতিক সমীকরণ

গত ১৫ নভেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) ১০টি দেশসহ এশিয়া-প্যাসিফিকের মোট ১৫টি দেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। 

রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) বা ‘আরসেপ’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই জোটের সদস্য দেশগুলোর মাঝে পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মাঝে পড়েছে ২২০ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং এর ২৬.২ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি গোটা বিশ্বের ২৯ শতাংশ। 

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর বাণিজ্য চুক্তি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এই চুক্তি বড়। স্বাক্ষর করা দেশগুলোর মাঝে চীন ছাড়াও মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কমনওয়েলথ ও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে জোটের বাইরে থাকা দেশগুলোর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। এরকম বিরল ঘটনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু? 

আরসেপের আলোচনা শুরুর হয় ২০১২ সালে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বের হয়ে আসার ঘোষণা দেবার পর থেকেই আরসেপের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ওবামা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘টিপিপি’ নিয়ে যখন কথা চলছিল, তখনই প্রতিদ্বন্দ্বী চুক্তি হিসেবে আরসেপের আবির্ভাব হয়। 

বিবিসি তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ‘আরসেপ’ প্রকৃতপক্ষে ‘টিপিপি’র মতো শুল্ক কর্তনের দিকে যায়নি। তবে এর আকার এটাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে; বিশেষ করে এর মাঝে চীন থাকার কারণে পুরো জোটের একত্রিত জিডিপি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যদিও চীন এতকাল অনেক দেশের সাথেই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে, এবারই প্রথম তারা বহুপক্ষীয় কোনো বাণিজ্য চুক্তির মাঝে ঢুকেছে। চীনা প্রধানমন্ত্রী লী কেকিয়াং বলেন, আট বছর ধরে দর কষাকষির পর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি এই চুক্তিকে ‘বহুমুখিতা ও মুক্ত বাণিজ্যে’র বিজয় বলে উল্লেখ করেন। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি তাদের বিশ্লেষণে জানায়, এই চুক্তি চীনের জন্য একটি ভূরাজনৈতিক বিজয়; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যখন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে সরে আসছিল। এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে, হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এর বিপরীতে নতুন কোনো বড় বাণিজ্য চুক্তির দিকে এগুবে কি-না। 

  • এই চুক্তিটি অনেককেই মনে করাবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পারস্পরিক সহযোগিতায় অধিকতর বিশ্বাসী চীন। আরসেপের কারণে চীন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হবে না; কারণ চীন ইতিমধ্যেই অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। অপরদিকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব একটি প্রভাব বলয় তৈরি করতে চাইছে জাপান; যার অংশ হিসেবে জাপান এই চুক্তির অংশ হয়েছে....
    সিটি ব্যাংকের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সিটি রিসার্চ’ তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে যে, অর্থনৈতিকভাবে এই চুক্তি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্ব বহন করছে এর কূটনৈতিক বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে এই চুক্তি বার্তা দিচ্ছে যে, পূর্ব এশিয়া মুক্ত বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। চীন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে বলে অনেকে মনে করছিল, তা আসলে ঠিক নয়। এছাড়াও এটি এখন বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুধু যুক্তরাষ্ট্র অথবা শুধু চীনের সাথে থাকার পক্ষপাতি নয়। এ কথা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। 

ভারতও এই চুক্তির আলোচনায় অংশ নেয়। তবে গত বছর কমদামি চীনা পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবার ভয়ে ভারত এই চুক্তির আলোচনা থেকে নিজেকে উঠিয়ে নেয়। ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ গ্যারেথ লেদার বলেন, চুক্তিতে ভবিষ্যতে ভারতের ফিরে আসার জন্য দরজা খোলা রাখা হয়েছে। জাপানিরাই মূলত ভারতকে চেয়েছিল চীনের অর্থনৈতিক আকৃতিকে ব্যালান্স করতে। তবে হিমালয়ের পাদদেশে চীনের সাথে ভারতের দ্বন্দ্বের ফলে এই চুক্তিতে থাকাটা ভারতের জন্য কঠিন হয়ে যায়। সিটি রিসার্চ জানায়, আরসেপে না থাকার কারণে ভারত বিরাট একটি সুযোগ হারিয়েছে। 

তবে অনেকে বলছেন, স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য এই চুক্তি বড় কোনো সুবিধা নিয়ে আসবে না, আর এর বাস্তবায়নে অনেক বছর লেগে যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আরসেপ, টিপিপির মতো শক্তিশালী চুক্তি নয়; এর বাধ্যবাধকতা বেশ অনেকটাই কম। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের নীতি ও ভর্তুকি দেয়ার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আরসেপের সদস্য দেশগুলোর মাঝে ইতিমধ্যেই দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি ছিল। আসিয়ানের দেশগুলোর মাঝে মোট বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ ইতিমধ্যেই শুল্কবিহীনভাবে হয়ে থাকে। 

তবে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক প্রধান অর্থনীতিবিদ সায়মন ব্যাপটিস্ট বলেন, আরসেপের যে দেশগুলোর মাঝে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নেই, সেই দেশগুলোর মাঝে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এইচএসবিসির হিসাবে, ২০৩০ সালের মাঝে আরসেপের দেশগুলোর একত্রিত জিডিপি দাঁড়াবে বিশ্বের ৫০ শতাংশ। চুক্তির আগে থেকেই গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে, তা চুক্তির পরেও অব্যাহত থাকবে। 

আরসেপ অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে পরিবর্তিত করেনি। এখনো এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বকে টার্গেট করেই। এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মাঝে পণ্যের ‘কম্পোনেন্ট’ বা অংশবিশেষ নিয়ে বাণিজ্য করে, যাতে পশ্চিমা বাজারে ‘ফিনিশড প্রডাক্ট’ বা সর্বশেষ পণ্য আরো প্রতিযোগিতামূলক হয়। এই লক্ষ্যে আরসেপ সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে মাত্র। 

ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক স্ট্রাটফরের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রজার বেকার বলেন, ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার ফলে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশের কাছেই নতুন শুল্কমুক্ত এলাকার গুরুত্ব বেশ কিছুটা কমে গেছে। সদস্য দেশগুলোর জন্য চুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট পদ্ধতি রাখার ফলে এটি অত শক্তিশালী চুক্তি নয়। তবে এই চুক্তিটি অনেককেই মনে করাবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পারস্পরিক সহযোগিতায় অধিকতর বিশ্বাসী চীন। আরসেপের কারণে চীন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হবে না; কারণ চীন ইতিমধ্যেই অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। 

অপরদিকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব একটি প্রভাব বলয় তৈরি করতে চাইছে জাপান; যার অংশ হিসেবে জাপান এই চুক্তির অংশ হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //