ভয়াল সেই দিনটিকে স্মরণ করছে জাপান

১০ বছর আগে এই দিনে প্রচণ্ড ভূমিকম্প, সুনামি আর পারমাণবিক কেন্দ্র বিস্ফোরণে বিপর্যয় নেমে এসেছিল জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া সেই দিনটিকে স্মরণ করছে শোকসন্তপ্ত জাপান।

২০১১ সালের ১১ মার্চ ঠিক ২টা ৪৬ মিনিটে শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার সেই ভূমিকম্পের ফলে শুরু হয় সুনামি। এতে সমুদ্রের পাশে অবস্থিত ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নামের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ কারণে কয়েকটি রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত চুল্লি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। 

সুনামিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর হোক্কাইডো থেকে শুরু করে ওকিনাওয়া পর্যন্ত এলাকার প্রায় সব ঘর-বাড়িই ধ্বংস হয়ে যায়। সেদিনের সেই প্রাকৃতিক ও পারমাণবিক চুল্লির বিপর্যয়ে মারা যায় প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ মানুষ। অন্তত দুই হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ। 

জাপানের মানুষ প্রতিবছর দিনটি নানা আচার–অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে।

ওইদিন সুনামি এসে আঘাত করেছিলেন কেন্দ্রটির দেয়ালে। ছবি: বিবিসি

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর ফুকুশিমার ১২ শতাংশ এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ১ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় বাড়িঘর ছাড়ে অথবা কর্তৃপক্ষ তাদের উদ্ধার করে। কর্তৃপক্ষ একটি এক্সক্লুসিভ জোন তৈরি করে যা দিন দিন বড় হতে থাকে, কারণ ওই কেন্দ্রটি থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছিল।

পরে ব্যাপক আকারে তেজস্ক্রিয়তা নিষ্ক্রিয়করণ কার্যক্রম পরিচালনার পর অনেক এলাকাকে নিরাপদ ঘোষণা করা হয়। বাড়িঘরে ফিরে যেতে অনেক আর্থিক সুবিধার ঘোষণা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তার ভয়ে অনেকে ঘরে ফিরতে ইচ্ছুক নয়। 

ওই ঘটনার এক দশক পরেও ওই এক্সক্লুসিভ জোনটি যেমন ছিলো তেমনই আছে এবং সেখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী আর ফিরে আসেনি। কর্তৃপক্ষের ধারনা সেখানকার কাজ শেষ করতে অন্তত ৪০ বছর সময় লাগবে এবং এর জন্য জাপানের ইতিমধ্যেই ব্যয় হয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন ইয়েন।

যা হয়েছিলো ফুকুশিমায়

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সিস্টেম থেকে ভূমিকম্প চিহ্নিত হয়েছিল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ হয়ে যায়। তবে কুলিং সিস্টেম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি ডিজেল জেনারেটরগুলো চালু হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় ১৪ মিটার বা ৪৬ ফুট উঁচু ঢেউ ফুকুশিমায় আঘাত হানার পর পুরো কেন্দ্র পানিতে সয়লাব হয়ে যায় ও জরুরি জেনারেটরগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।

কর্মীরা বিদ্যুৎ পুনরায় চালুর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই রিয়েক্টরের মধ্যে পারমাণবিক ফুয়েল প্রচণ্ড গরম হয়ে যায় ও কোরের একটি অংশ গলে পড়ে। এরপর ওই কেন্দ্রে কয়েকটি রাসায়নিক বিস্ফোরণ হয় যাতে পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেডিও এক্টিভ উপকরণগুলো লিক হয়ে বেরিয়ে এসে পরিবেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

অনেকেই আর বাড়িঘরে ফিরে আসেননি। ছবি: বিবিসি

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপর্যয়ে তাৎক্ষনিকভাবে কেউ মারা যায়নি তবে বিস্ফোরণে কেন্দ্রটির ১৬জন কর্মী আহতে হয়েছিল। আর রিয়েক্টর নিয়ে যারা কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে রেডিয়েশনে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে কয়েকজনকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এ বিপর্যয়ের ক্ষতি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৩ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, ওই বিপর্যয় অঞ্চলটিতে ক্যান্সারের হার বাড়ায়নি।

জাপানের ভেতর ও বাইরের বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন রেডিয়েশনের ঝুঁকি ছিলো তুলনামূলক কম। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন- এর বিপদ ছিলো অনেক বেশি।

২০১৮ সালে জাপান সরকার ঘোষণা দেয়, রেডিয়েশনের কারণে একজন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তবে স্থানীয় হাসপাতাল ও বাড়িঘর থেকে লোকজনকে জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেয়ার সময় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি ওই দুর্ঘটনাকে সাত মাত্রার দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যা এ ধরণের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। রাশিয়ার চেরনোবিল এর দ্বিতীয় উদাহরণ।

এই ঘটনার ১০ বছর পরেও জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেকগুলো শহর কার্যত বন্ধ আছে ও কর্তৃপক্ষ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে যাতে অধিবাসীরা ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু বড় ধরণের চ্যালেঞ্জও আছে।

হাজার হাজার শ্রমিক দরকার হবে আগামী ৩০/৪০ বছরে নিরাপদে বিভিন্ন ধরণের পারমাণবিক বর্জ্য সরিয়ে নেয়ার জন্য। রেডিয়েশনের ভয়ে কিছু অধিবাসী সেখানে আর কখনোই না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। -ডয়চে ভেলে ও বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //