শতবর্ষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং কিছু প্রশ্ন

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বয়স একশ’ বছর হয়ে গেল। কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এটা দীর্ঘ সময়। তবে চীনের সমৃদ্ধ সমাজ এবং রাজনীতির ঐতিহ্য তার চেয়েও পুরনো। চীনাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বজোড়া খ্যাতি নতুন নয়। জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে ‘সুদূর চীন’ দেশে যেতে মহানবীর (সা.) পরামর্শ সবার মুখে মুখে। চীনাদের সক্ষমতার নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাপ্রাচীর। মঙ্গোলীয় সেনাপতি চেঙ্গিস খানের হামলা থেকে সুরক্ষায় চীনের এই সুরক্ষা প্রাচীর। ছিং ও মিং রাজবংশের সময়ে রাজধানী বেইজিংয়ে নির্মিত হয় ‘নিষিদ্ধ নগরী’। কালের ধারায় আজ থেকে একশ’ বছর আগে সাংহাই নগরীতে মাত্র কয়েকশ’ নেতাকর্মী নিয়ে গড়ে ওঠে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। আজ এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। 

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসনকালে দলটির মাও সেতুংয়ের আমলকে পুরাদস্তুর সমাজতান্ত্রিক শাসনামল বলা যায়। ওই সময়ে আবদ্ধ সমাজে সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রেখে শ্রমিকের কল্যাণ সাধনে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এশীয় শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থে মাও সেতুংয়ের শাসনকালের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে কল্যাণ রাষ্ট্রের দেখা পাওয়া যায়।

শ্রমিক শ্রেণির জন্য ওই সময়টি ছিল স্বর্ণযুগ। বিশ্বের পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে সাদাসিধা এক রাষ্ট্রনায়ক নিজের দেশকে গড়ে তোলেন। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও শোষণের বিরুদ্ধে অবহেলিত মানুষকে সুরক্ষায় মাও সেতুংয়ের নীতি বিশ্বব্যাপি পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে প্রতীকে পরিণত হয়। মাও সেতুং বিশ্বের শান্তিকামী এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।

মাও সেতুংয়ের পর চীনের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতে থাকে। ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াং পিংয়ের শাসনকালে উন্মুক্ত নীতি গৃহীত হয়। তার ফলে ব্যক্তিগত পুঁজির বিকাশ ঘটে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত চীনের সমাজকে আধা সমাজতন্ত্র এবং আধা পুঁজিবাদী সমাজ বলা যায়। দেং জিয়াং পিং চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে যে ধরনের নেতৃত্ব দেন; তারা চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নাম দিয়েছেন ‘সমাজতন্ত্র চীনা স্টাইল’। আজকে শি জিনপিংয়ের আমলে ধারাটা আরও বিকশিত হয়েছে। 

চীনের বর্তমান সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা যায়। সে কারণে আলী বাবার মতো ধনকুবেরের জন্ম হচ্ছে। জমির মালিকানা রাষ্ট্রের থাকলেও, সেটা একশ’ বছর কিংবা নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদের জন্য লিজ নিয়ে বাড়ি করা যায়। বাড়িতে এপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। কমিউনিজমের এই নয়া চেহারা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের জাতি গঠনে আত্মত্যাগের মহিমা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাই সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারে না। চীনের জনসংখ্যা একশ’ কোটির বেশি হলেও, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ৯ কোটিরও কম।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে। দেশটিতে সাধারণ মানুষের কোনো ভোটাধিকার নেই। দলের নেতাকর্মীরা দলের নেতা নির্বাচন করেন। দলের নেতাই দেশের নেতা। দেশের বেশিরভাগ মানুষ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নন। চীনে রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ আলোচনা করতে পারে না। বিদেশিরা কেউ রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা-সমালোচনা করলে, তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। চীনের নাগরিক নিজেরাও রাজনীতির আলোচনা করেন না। তবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা পার্টির ফোরামের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেন। চীনে ভিন্নমত কঠোর হস্তে দমন করার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো তিয়েন আনমিন স্কোয়ারে নিষ্ঠুরতা চালানোর ঘটনা। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং দেশের শৃঙ্খলা রক্ষায় চীনের নেতারা খুবই নিষ্ঠুর। মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা চীনে নেই। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো আক্ষেপ আছে কি-না, সেটি জানাও সম্ভব নয়। কারণ বিষয়টি নিয়ে তারা কোনো খোলামত প্রকাশ করে না।

চীনে এই কঠোর হস্তে শাসনের ফলে দেশটিতে কোনো বিদ্রোহ দানা বাঁধতে পারেনি। ফলে বিশাল দেশ হলেও ভৌগোলিক অখ-তা বিদ্যমান। কমিউনিস্ট শাসকরা যা বলে সেটা তারা বাস্তবায়ন করে ছাড়ে। একবার তারা এক সন্তান নীতি গ্রহণ করল। সেটা তারা বাস্তবায়ন করেছে জনসংখ্যা সীমিত রাখার লক্ষ্যে। এতে করে চীনের জনসংখ্যা কমল ঠিকই; কিন্তু তাদের অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে গেল। জনসংখ্যার ওপর সেই বিধি-নিষেধ তারা তখন তুলে নেয়। করোনাভাইরাসের মহামারি উহানে সূত্রপাত হলে তারা এমন কঠোর নিয়ম করল যে, এই ভাইরাস চীনে উহানের বাইরে বেশি ছড়াতে পারল না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শি জিনপিং কঠোর। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা দেশপ্রেমিক এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের প্রয়োজনে তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে পারে। আরও অনেক কিছু করতে পারে। 

চীন এসব কঠোর শাসনের কারণে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। কিছুদিন আগেও চীনে শ্রম খুব সস্তা ছিল। এ কারণে শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। তার ওপর চীনারা খুবই পরিশ্রমী জাতি। এসব কারণে বিপুল জনগোষ্ঠী উৎপাদনে সম্পৃক্ত হওয়ায় অর্থনীতি মজবুত হয়। তার সঙ্গে নীরবে নিরাপত্তা বাহিনী শক্তিশালী করেছে। বিজ্ঞান ও গবেষণায় উন্নতি করেছে। মহাকাশে এখন চীনের নভোচারিরা হাঁটছেন। এভাবে চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বে অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। 

চীন এতদিন পর্যন্ত অন্যের বিষয়ে তেমন কোনো কথা বলতো না। আড়ালে-আবডালে নীরবে কাজ করে গেছে। সেই নিভৃতচারিতার অবসান হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উপলক্ষে পার্টির নেতারা বিশ্বের ১৬০টি দেশের ৫০০ রাজনৈতিক দলের       নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভার্চুয়ালি মতবিনিময় করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দলের আমৃত্যু নেতা হয়েছেন। দলের ভেতরে এভাবে এক ব্যক্তিকে আমৃত্যু নেতা বানানোর প্রক্রিয়াটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। 

চীনে শিনজিয়ান প্রদেশের কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চীনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নাম হান সম্প্রদায়। তবে শিনজিয়ান প্রদেশে বাস করেন উইঘুর নামের মুসলিম সম্প্রদায়। ওই প্রদেশে মধ্য এশিয়ার অনেক দেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। যেমন-পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান প্রভৃতি। তাই তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মধ্য এশিয়ার মুসলিম সংস্কৃতির মিল আছে। চীনে হানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শিনজিয়ানে উইঘুররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। উইঘুর মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার বিভিন্ন বিষয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের অভিযোগ আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

শি জিনপিং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগের লক্ষ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) ইনিশিয়েটিভ গ্রহণ করেছেন। চীনের হাতে তাদের অর্থ বিনিয়োগে চীনের বিশ্বব্যাংক খ্যাত এশীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক গঠন করা হয়েছে। এসব করে অর্থনীতি চাঙা করার পাশাপাশি চীনের আধিপত্য বৃদ্ধির চেষ্টাও অব্যাহত আছে। এসবের সমালোচনাও আছে। অনেকে মনে করছেন, অনেক দেশকে ঋণের বাঁধনে আবদ্ধ করে ফেলছে চীন।

চীনে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে পশ্চিমারা প্রশ্ন তুলেছে। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করতে পারেন না। উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নামাজ, রোজাসহ ধর্ম পালনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে দেশটি। এসব নিয়ে তুমুল সমালোচনা পশ্চিমা বিশ্বে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি দেশের ভাবমূর্তি নাজুক হয়ে উঠলে, সেটা শেষ অবধি নেতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। চীনের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রশ্নাতীত নয়। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি মানব কল্যাণে যথাযথ কাজে লাগাতে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। চীন তাদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াও দেশটির বৈশিষ্ট্যের দৃশ্যমান পরিবর্তন।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //