ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে এশিয়ার অর্থনীতি

বিশ্বের কিছু দেশ একসময় পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর প্রভাব সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে পারলেও, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, এশিয়া অঞ্চলের কথা। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর এশিয়ার দেশগুলো আবারও লকডাউনে ফিরে গিয়েছে; অন্যদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো সর্বোচ্চ পরিমাণ মৃত্যুর হার দেখতে পাচ্ছে।

মাত্র ১২ মাস আগেও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো এতটাই দ্রুতহারে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল, যা বিশ্বের কাছে রীতিমতো ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; কারণ ভাইরাসটি তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তা-ব চালাচ্ছে; কিন্তু বর্তমানে সিউল থেকে সিডনি, ব্যাংকক থেকে বেইজিং কর্তৃপক্ষ প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। কারণ এসব দেশে টিকাদান ধীর হওয়ার কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষের জনজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। 

তবে ডেল্টার প্রভাব ও অর্থনীতির ধাক্কায় এখন পর্যন্ত ভোক্তারাই সবচেয়ে ভুক্তভোগী। অস্ট্রেলিয়ায় ডেল্টা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে ভ্রমণের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে; ফলে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিকই ঘরের ভেতরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ায় লকডাউন চলাকালে ভোক্তা ব্যয় ১৫ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

উহান ও বেইজিংয়ের মতো স্থানে পুনরায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে গ্রীষ্মের ছুটির মাঝামাঝি সময়ে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ও চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীন। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটির প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস কমে গিয়েছে। চীনের জিডিপিতে ৩৮ শতাংশ অবদান রাখে- এমন অঞ্চলগুলোতে ডেল্টা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, যা দেশটির অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

ডেল্টা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভিয়েতনাম থেকে থাইল্যান্ডের সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হচ্ছে। নাইক ইনকরপোরেশন ও অ্যাডিডাস এজির মতো পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো ভাইরাস সংক্রমণের কারণে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। ছুটির দিনে ক্রেতাদের জমজমাট কেনাকাটা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে এসব কোম্পানি। রফতানি যদি এভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাপী ডেল্টার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

এইচএসবিসি হোল্ডিংসের এশিয়ান ইকোনমিক রিসার্চের সহকারী প্রধান ফ্রেডরিক নিউম্যান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এশিয়ায় বর্তমানে চলমান ডেল্টার ধাক্কা উৎপাদন নেটওয়ার্ককে আবারও প্রভাবিত করবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোয় যেখানে ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে ডেল্টার প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছে, সেখানে পুনরায় ভ্রমণ চালুর প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিকের অনেক দেশেই একক বিষয় রয়েছে, তা হচ্ছে তারা ভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করে প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছে। এই আত্মতৃপ্তিই এসব দেশের ক্ষতির কারণ হয়েছে। মৃত্যুর হার কম থাকার কারণে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে। ওইসিডিভুক্ত সদস্যদের মধ্যে এসব দেশ এখন টিকাদানকারী দেশগুলোর তালিকায় নিচের দশে রয়েছে। 

এ অবস্থায় সবাই আশঙ্কা করছে নিউজিল্যান্ড ডেল্টার কারণে মারাত্মক প্রভাবিত হবে। অন্যদিকে গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণের হার তিনগুণ, জাপানে চারগুণ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ৬০০ শতাংশ বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম শহরগুলোতেও সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এর মধ্যে সিডনি ও মেলবোর্নে বর্তমান সংক্রমণ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। 

জাপানের অলিম্পিক একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু রাজধানী টোকিওসহ অন্যান্য শহরগুলোয় আরেক দফা জরুরি অবস্থা জারি করার পর এ সম্ভাবনায় ভাটা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের টিকা দেওয়ার কারণে তাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েনি, তবে অলিম্পিক ভিলেজের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেল্টা ভাইরাস ব্যাপকহারে সংক্রমিত হয়েছে। 

দেশে আরোপিত জরুরি অবস্থা নিয়ে জাপানের অনেক নাগরিকই হতাশ হয়ে পড়েছেন। ট্রেন স্টেশনগুলোয় ভিড় কমানোর আহ্বানে তারা খুব একটা সাড়া দিচ্ছেন না। এ ছাড়া বার ও রেস্টুরেন্টগুলো তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করার সরকারের অনুরোধ প্রকাশ্যে মেনে চলছে না। 

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জাপানের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস কমিয়েছে। এশিয়ার বৃহত্তম খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি ইউনিক্লোর অপারেটর ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানি জাপানে কোভিড নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য এশিয়া বাজারে লকডাউনের কারণে গত জুলাইয়ে তাদের পুরো বছরের পরিচালন মুনাফা কমিয়েছে। 

ভয়াবহ বন্যা, রফতানি ও বিনিয়োগে ধীরগতির পর চীনে ডেল্টা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে পূর্ব চীন সাগর অঞ্চলজুড়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধির বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গ্রীষ্মকালীন ছুটির মৌসুমেও খুচরা বিক্রি খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি। উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোয় যাত্রী চলাচল কমে যাওয়ায় আসন সক্ষমতাও কমানো হয়েছে। 

চীনের ভ্রমণস্থল হুনান প্রদেশে ডেল্টা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রদেশের পর্যটনস্থল ঝাংজিয়াজেইর একটি হোটেলের বিক্রয় ব্যবস্থাপক শেই বলেন, ‘স্বাধীন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় আমরা কোনো ক্রেতাই পাচ্ছি না এখন।’ সাধারণত গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে ৩০ কক্ষের এই হোটেলটির মাসে বিক্রি থাকে তিন লাখ ৯ হাজার ডলার; কিন্তু গত ৩০ জুলাই থেকে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর তাদের ব্যবসা বলতে গেলে বন্ধ হয়ে পড়েছে। 

দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ টিকাদান কর্মসূচির আওতায় এসেছে। বর্তমানে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৫ হাজার; যার মধ্যে ৩০ শতাংশই গত দুই মাসে আক্রান্ত হয়েছে। করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর এই মুহূর্তে দেশটি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন সিউলকে অর্ধ-লকডাউনের মধ্যে রেখেছেন। সন্ধ্যা ছয়টার পর সেখানে একসঙ্গে দু’জন লোকের একত্রিত হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংক অব কোরিয়ার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এখনো চলমান। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে, যেখানে চলতি প্রান্তিকে জিডিপি কমতে পারে, এমন সম্ভাবনা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাপ্তাহিক বন্ড ক্রয় হ্রাসের চিন্তাভাবনা করছে। 

দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এখন ডেল্টা ভাইরাসে আক্রান্ত বিশ্বের নাজুক হয়ে পড়া অন্যতম অঞ্চল। সম্প্রতি সাপ্তাহিক মৃত্যুর হারের দিক থেকে লাতিন আমেরিকাকেও টপকে গেছে এ অঞ্চল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডেল্টা ভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল বলা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়াকে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জকো উইডুডু চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন; যা অঞ্চলটির বৃহত্তম অর্থনীতি আরেক দফা নজুক হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কয়েকটি উজ্জ্বল অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম লকডাউনে বিশেষ আশঙ্কায় রয়েছে। ফেডারেশন অব থাই ইন্ডাস্ট্রিজ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে, কোয়ারেন্টাইন ও চলাচলে সীমাবদ্ধতার কারণে শ্রমিক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে কোম্পানিগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের এই প্রভাব আমেরিকার খুচরা বিক্রেতারাও বিঘ্ন অনুভব করছে। আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী ল্যামার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ‘ভিয়েতনামসহ অন্যান্য ব্যবসায় সহযোগী দেশে দ্রুত মার্কিন ভ্যাকসিন পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন’। 

ভারতে গত বছর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয়। করোনার এই দ্বিতীয় ধাক্কায় লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এর ধাক্কা অর্থনীতিতেও লেগেছে; যার ধারাবাহিকতায় গত মাসে আইএমএফ ভারতের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। 

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল সমৃদ্ধ নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরও সংগ্রাম করছে। সম্প্রতি দেশটিতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকার পুনরায় বিধিনিষেধ আরোপে বাধ্য হয়েছে। 

সূত্র : ব্লুমবার্গ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //