অনিশ্চয়তার পথে আফগানিস্তান

আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরায় ক্ষমতা দখলের দুই বছর পূর্ণ হলো ১৫ আগস্ট। ২০২১ সালের এই দিনে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান থেকে সরে গেলে তালেবান রাজধানী কাবুলসহ বেশ কয়েকটি শহর ও অঞ্চল দখল করে। পতন হয় মার্কিনপন্থি আশরাফ গনি সরকারের। প্রথম দিকে তালেবান আগের চেয়ে নমনীয় হওয়ার আভাস দিয়েছিল। তবে বাস্তবে তা হয়নি। এখন পর্যন্ত তালেবানের স্বীকৃতি দেয়নি কোনো দেশ। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রতি বিশ্বের মোড়লদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় দর কষাকষিও সেভাবে হচ্ছে না। ফলে কার্যত এক বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিয়েছে দেশটি, যেখানে রয়েছে শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

দুই বছর পরও শঙ্কায় রয়েছেন বিচার বিভাগের কর্মীরা। সরকার পক্ষের প্রায় ৪ হাজার উকিল (প্রসিকিউটর) ও বিচারক আফগানিস্তানে তালেবানের সহিংসতার হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। গত দু বছরে ২৮ জন উকিল ও তাদের পরিবার নিহত হন বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর নাজিয়া মাহমুদি। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে আফগানিস্তানে ৫০টি ঘটনায় মোট ৩৪৬ জনকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বড় বড় স্টেডিয়াম বেছে নেওয়া হয়। এটা এমন এক ঐতিহ্য, যা ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়েছিল, যখন তালেবান গোষ্ঠী প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের শাসন-ক্ষমতা দখল করেছিল।

আফগানিস্তানের সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। কাবুলে সংবাদ সম্মেলন করে তালেবানের বিচারমন্ত্রী আবদুল হাকিম শারাই এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। সেখানে এই পদক্ষেপের বিশদ বিবরণ না দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করার কোনো শরিয়া ভিত্তি নেই। তারা জাতীয় স্বার্থে কাজ করে না, দেশবাসীও তাদের পছন্দ করে না।’ তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগ পর্যন্ত ৭০টিরও বেশি বড় ও ছোট রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির বিচার মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত ছিল। ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিরোধী ও সমালোচকদের দাবিয়ে রাখতে সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতাকে ক্রমাগতভাবে খর্ব করে এসেছে তালেবান। এ ছাড়া আফগানিস্তানের সংবাদ মাধ্যমগুলোও ধারাবাহিকভাবে তালেবানের আক্রমণ ও দমন-পীড়নের মুখে রয়েছে। আর এর ফলে বহু সংবাদ মাধ্যম ও নিউজ আউটলেট বন্ধ করে দিতে বাধ্য করা হয়েছে এবং শত শত সাংবাদিক দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

তালেবান আবার ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় বদলটা দেখছেন আফগান নারীরা। ক্ষমতা দখলের পর নানা সংস্কারের ঘোষণা দেয় তারা। বিদেশি বিনিয়োগ, বেকারত্ব দূরীকরণ এবং নারী শিক্ষার সুযোগের কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। শিক্ষার পরিবেশ আর কাজের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে নারীদের জন্য। কাবুল দখলের মাসখানেক পরই তালেবান কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে মেয়েদের নিষিদ্ধ করে। তারা নতুন নির্দেশিকা জারি করে, ৭২ কিলোমিটারের বেশি দূরে ভ্রমণ করলে নারীদের অবশ্যই পুরুষ নিকটাত্মীয়কে সঙ্গে নিতে হবে। গত বছরের মে মাসে মেয়েদের পোশাকের নতুন বিধান চালু করা হয়। স্বাস্থ্য খাত ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নারীদের চাকরিচ্যুত করা হয়। গত জুলাই মাসে আফগানিস্তানের সব বিউটি স্যালুন বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় তালেবান। এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন দেশটির প্রায় ৬০ হাজার নারী। জীবন ও জীবিকার চাহিদা মেটানোর জন্য এটিই ছিল তাদের একমাত্র অবলম্বন। 

এইচআরডব্লিউর সহযোগী পরিচালক হিদার বার বলেন, ‘গত দুই বছর আফগানিস্তানে নারীর অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সবচেয়ে বাজে বিষয়টি হলো, এই পরিবর্তনকে সবাই মেনে নিয়েছেন। তালেবান নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর নারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে নারীদের বিভিন্ন সুযোগের ওপর।’ জাতিসংঘের বিশ্ব শিক্ষা বিষয়ক দূত গর্ডন ব্রাউন ১৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের উদ্দেশে আফগানিস্তানে লিঙ্গবৈষম্যকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে ঘোষণা করার ডাক দিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তালেবানের ৮০টি অধ্যাদেশের মধ্যে ৫৪টি নারী অধিকার খর্ব করেছে। এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত মানবাধিকারকর্মী মাহবুবা সিরাজ মনে করেন, ‘আফগানিস্তানে নারী স্বাধীনতা বলতে আর কিছুই নেই। সমাজ থেকেই ধীরে ধীরে মুছে দেওয়া হচ্ছে নারীদের। তাদের মতপ্রকাশ, কথা, চিন্তা সবকিছুই মুছে দেওয়া হচ্ছে।’

বিশ্লেষকদের মতে, নারীদের চাপে রেখে মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নিজেদের স্বীকৃতি আদায় করতে চায় তালেবান। নারীদের নেতৃত্বে পরিচালিত অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যম জেন টাইমসের সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা জাহরা নাদের বলেন, ‘আলোচনা করে কী হবে? তারা কেমন মানুষ আর তারা কী ধরনের সমাজ গঠন করতে চায়, তা তারা দেখিয়ে দিয়েছে।’ তবে তালেবানের মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে সম্প্রতি পশ্চিমা কূটনীতিকদের বৈঠক হয়েছে। একজন কূটনীতিক বলেন, আগ্রহী আফগানদের যদি আলোচনার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে শাসন ক্ষমতা এমন মানুষদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে, যারা জনগণের একটা বড় অংশকে কার্যত বন্দি করে রাখতে চায়।

সম্প্রতি তালেবানের শীর্ষ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার সঙ্গে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানির বৈঠক হয়। এটি কোনো বিদেশি কর্মকর্তার সঙ্গে আখুন্দজাদার প্রথম বৈঠক। এ আলোচনা সম্পর্কে কূটনীতিকরা বলেছেন, আলোচনায় অনেকখানি ব্যবধান থেকে গেছে, বিশেষ করে শিক্ষা ও নারী অধিকার বিষয়ে। তবে ধীরে হলেও সামনে একটি সমাধানে পৌঁছার ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। আফগানিস্তান অ্যানালিস্ট নেটওয়ার্কের বিশ্লেষক কেট ক্লার্ক বলেন, বছরের পর বছর ধরে লড়াইকারী পক্ষগুলোর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা রয়েছে। তালেবান মনে করে পশ্চিমারা এখনো তাদের দেশকে নীতিভ্রষ্ট করতে চাইছে। নারী অধিকার ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষেত্রে তালেবানের যে নীতিমালা রয়েছে, তা পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন করে না। পশ্চিমারা হয়তো মনে করছে স্বীকৃতির মতো বিষয় তালেবানকে সুবিধা দেবে। আর তালেবান স্বীকৃতিকে তাদের অধিকার মনে করে। 

তালেবান সরকার এখনো কোনো স্বীকৃতি না পেলেও তাদের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন দেশ সফরে যাচ্ছেন, সেসব দেশের সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আবার তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি প্রায় প্রতিদিনই কাবুলে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এসব অতিথিকে নিয়মিত প্রটোকলও দেওয়া হচ্ছে। বৈঠকের ছবিও প্রকাশ করা হচ্ছে। পরিবর্তিত অবস্থা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আফগানদের ওপর। বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হওয়া দেশটি চার দশক ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিধ্বস্ত। নতুন করে আবার একটি রক্তাক্ত অধ্যায় যুক্ত করতে চাইবে না কেউই। আবার তালেবান নেতাদের মধ্যে মতভেদও রয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে যারা চরম রক্ষণশীল মানসিকতায় বড় হয়েছেন, নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে মেনে এসেছেন, তারা রাতারাতি উদারনৈতিক কোনো অবস্থান মেনে নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। আর এ বাস্তবতায় কোনো সহজ সমাধান সামনে নেই আফগানিস্তানের। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে একদা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির এ জনপদ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //