সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের অভিযান

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। দেশটির কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানো, বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেন্সর করার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সেখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ মিডিয়াই সরকারপন্থি। কৃষকদের আন্দোলন বা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ভারতীয় সাংবাদিককে তাদের প্রতিবেদনের জন্য ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সম্প্রতি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা অভিযোগ তুলেছে- এসব সংবাদমাধ্যম চীনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চীনের মতো ভাষ্য প্রচার করছে। অভিযোগ তুলেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা দিল্লি পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটকে এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের দপ্তর ও সাংবাদিকদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে।

অভিযানে প্রথমে টার্গেট নিউজক্লিক নামের একটি সংবাদ সাইট। নিউজক্লিক ২০০৯ সাল থেকে ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। নিউজক্লিক শুরু থেকেই মোদির উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। তাই নিউজক্লিক ও তার সম্পাদক মোদি সরকারের রোষে পড়েছেন। ২০২১ সাল থেকেই তারা ইডি ও আয়কর দপ্তরের নজরদারিতে রয়েছে। তখনো সংস্থাটির ল্যাপটপ, ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবু নিউজক্লিক অনলাইন সংবাদ সংস্থা সংবাদ পরিবেশনে পরিবর্তন আনেনি। এর বিপরীতে গত ৩ অক্টোবর নিউজক্লিকের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় চীনের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার। অভিযানে নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, কর্মী, সাবেক কর্মী ও ফ্রিল্যান্স লেখকদের পাশাপাশি অ্যাক্টিভিস্ট, ইতিহাসবিদ ও স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানসহ মোট ৪৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, কৃষকদের ধর্মঘটসহ সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে নিউজক্লিক সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই সিরিজ প্রতিবেদনের সঙ্গে কোন কোন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট রয়েছে, তা জানার জন্য বারবার প্রশ্ন করা হয়। অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও কাগজপত্র জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সবাইকে ছেড়ে দিলেও নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও মানবসম্পদ প্রধানকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’-এর জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নিউজক্লিকের দিল্লি দপ্তর বন্ধ করে সিলগালা করে দেওয়া হয়। তবে ঠিক কোন সংবাদ প্রতিবেদনটি নিয়ে অভিযোগ, তদন্তকারী সংস্থা তা জানায়নি। যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এই বিপুল তল্লাশি ও গ্রেপ্তার, সে সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি। 

নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সূত্রপাত হয়েছে টাইমস ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মার্কিন প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ার নেভিল রয় সিংগাম একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। এই নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী চীনা ভাষ্য প্রচার ও প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এই গ্লোবাল নেটওয়ার্ক পরিচালনার জন্য নিজস্ব তহবিল রয়েছে। সেই তহবিল থেকে ভারতের সংবাদ সংস্থা নিউজক্লিক অনুদান সংগ্রহ করেছে। ২০২১ সালে টাইমস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), দিল্লি পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখা এবং আয়কর বিভাগসহ অসংখ্য সরকারি সংস্থার নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এরপর দুই বছরেরও বেশি সময় পার হলেও কোনো মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ দায়ের হয়নি। সর্বশেষ মোদি প্রশাসন সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিউজ সাইটটিকে আইনিভাবে হয়রানি ও নীরব করার চেষ্টা করেছে।

ভারতের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রবীশ কুমার বলেন, নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রক্রিয়াটি বিদেশি মিডিয়ার প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এতে তিলমাত্র সন্দেহের কারণ নেই যে, পুরো ঘটনাটি এক প্রবল প্রতিহিংসার প্রকাশমাত্র। এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। ছকটি পরিষ্কার- যে সাংবাদিকই কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের সমালোচনা করবে বা সরকারের বিপরীত মত প্রকাশ করবে তাকেই হয়রানির মুখে পড়তে হবে। যে সংবাদপত্র সরকারের সমালোচনা করবে, সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে; ওই প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন মামলার জালে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হবে। অথবা সরকারঘনিষ্ঠ কোনো শিল্পপতি ওই মিডিয়া কিনে নেবে। গত ১০ বছরে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে- ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, সাধারণ নাগরিক থেকে সাংবাদিক, সরকারের সমালোচনা করলে কারও রেহাই নেই।

মোদি সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪০তম। বর্তমানে ভারতের অবস্থান ১৬১তম। প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের সূচকে ভারতের অবস্থান প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের চেয়েও খারাপ। ভারতে নিউজক্লিকই প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে মোদি প্রশাসন বিভিন্ন বিতর্কিত কৌশল অবলম্বন করেছে। আট মাস আগে বিবিসি নিউজ ২০০২ সালের দাঙ্গায় মোদির সমালোচনামূলক ভূমিকা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে। এতে মোদি প্রশাসন বিবিসির ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং ভারতীয় কর কর্তৃপক্ষকে বিবিসির দিল্লি ও মুম্বাই দপ্তরে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়। শুধু বিরোধী মতের সংবাদপত্র নয়, মোদি প্রশাসনের তোপের মুখে পড়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। ২০২০ সালে ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এতে মোদি সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সব ভারতীয় দপ্তরে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাদের সব কার্যক্রম স্থগিত করে। শুধু তাই নয় তারা প্রতিষ্ঠানটির সব ভারতীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে।

ভারতের বর্তমান অবস্থাকে কেউ কেউ ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণা করা ‘জরুরি অবস্থা’ চলাকালে সংবাদমাধ্যমের ওপর আরোপ করা বিধিনিষেধের সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে এখন ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতে হয়নি। ‘জরুরি অবস্থা’ ছাড়াই দেশের সব সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে জানিয়ে দেওয়া গেছে যে, সেলফ সেন্সরশিপ বা স্বেচ্ছায় আত্মনিয়ন্ত্রণই বাঁচার একমাত্র পথ। মিডিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে কোনো ভোটে নির্বাচিত সরকারের এমন আক্রমণ নজিরবিহীন। তবে এরপরও সরকারপন্থি মিডিয়া ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমর্থনের আড়ালে মোদি সরকার তার ভিন্নমত দমনের পথ চালিয়ে যাচ্ছে।

ফ্রি স্পিচ কালেকটিভের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ বা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আটক করা হয়েছে। ৯ বিদেশি সাংবাদিককে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন কল্যাণ মৌলিক বলেন, “এখনকার অবস্থার মধ্যে শুধু স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদ নেই, এর পেছনে আছে এক ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ যা বহুত্ববাদী, সামান্য হলেও গণতান্ত্রিক ভারতকে মুছে দিয়ে এক হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। যে মানুষেরা আক্রান্ত হলেন, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে। এই মানুষেরা ২০১৪ সালে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিবিশিষ্ট ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যে নতুন, মহাশক্তিধর ভারতের গল্প দেশের মানুষকে গেলানো হচ্ছে, তা মেনে নেননি। তারা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছেন, প্রান্তিক, শোষিত মানুষের ওপর নেমে আসা ধারাবাহিক অত্যাচারের বিরোধিতা করেছেন, সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের বদলে নিজ নিজ বিশ্বাস মোতাবেক নতুন দেশ গঠনের কাজে ব্রতী হয়েছেন। তাই আজ শাসকদের কাছে তারা ‘দেশদ্রোহী’।’’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //