অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। সেই সঙ্গে মুদ্রানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি চীনের নীতিনির্ধারণী ফোরাম পলিট ব্যুরোর চলতি মাসের বৈঠক ও গত সপ্তাহের সেন্ট্রাল ইকোনমিক ওয়ার্ক কনফারেন্সে (সিইডব্লিউসি) ‘আরো সক্রিয় আর্থিক নীতি’র কথা বলা হয়েছিল। বেইজিংয়ের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী বছর বাজেট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ৪ শতাংশ, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চলতি বছর প্রাথমিকভাবে ৩ শতাংশ বাজেট ঘাটতির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। এই অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য প্রায় ৫ শতাংশ বজায় রাখা হয়েছে।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুদ্রানীতি ‘সতর্ক’ অবস্থান থেকে ‘মাঝারি শিথিল’ অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সুদহার হ্রাস ও তারল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে প্রত্যাশা বেড়েছে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া জানিয়েছে, দেশটি নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ভোক্তা ব্যয় বাড়ানোর ওপর জোর দেবে। এ ঘোষণার পর শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন ঘটেছে এবং বেড়েছে চীনের সরকারি বন্ডের দামও।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ ধরনের নীতির অবস্থান নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো ‘শিথিল’, ‘যথার্থভাবে শিথিল’, ‘সতর্ক’, ‘যথার্থভাবে কঠোর’ ও ‘কঠোর’। এগুলোর প্রতিটি নীতির ক্ষেত্রেই আবার উভয় দিকে নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি অনুযায়ী এসব নীতি সামান্য পরিবর্তন করতে পারে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর চীন ‘যথার্থভাবে শিথিল’ মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। তবে ২০১০ সালের শেষ দিকে ‘সতর্ক’ অবস্থানে ফিরে আসে।
চলতি বছর চীনের অর্থনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। দেশটির অর্থনীতিতে উৎপাদন ও রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেখা গেছে। কারণ আবাসন খাতের চাহিদা আশানুরূপ নয়। বাজারের গুরুতর সংকট ভোক্তাদের সম্পদকে লোকসানের মুখে ফেলেছে এবং বেশির ভাগ সরকারি প্রণোদনা যাচ্ছে উৎপাদক ও অবকাঠামো খাতে।
সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মহামারির পর থেকে সবচেয়ে আগ্রাসীভাবে মুদ্রানীতি শিথিলকরণের পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে সুদের হার কমানো ও আর্থিক ব্যবস্থায় এক ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সরবরাহ করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যার লক্ষ্য স্থানীয় সরকারগুলোর অর্থায়ন সংকট কমানো এবং দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল করা। তবে এসব ঋণের উদ্দেশ্য মূলত দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে পৌরসভার আর্থিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা; সরাসরি অর্থনীতিতে অর্থ বিনিয়োগ নয়।
চীন এ বছর প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হলেও ২০২৫ সালে সেই গতি বজায় রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসছেন এবং চীনা আমদানির ওপর ৬০ শতাংশ বা তার বেশি শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন তিনি। তাই আর্থিক অগ্রসরতার জন্য এই প্রণোদনা আবশ্যক ছিল।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক পরিষেবা সংস্থা এএনজেডের চীনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কৌশলবিদ শিং ঝাওপেং বলেন, ‘এটি শক্তিশালী আর্থিক প্রণোদনা, যা বড় সুদের হার কমানো এবং ২০২৫ সালে সম্পত্তি কেনার দিকে ইঙ্গিত দেয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই বিবৃতি ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির বিপরীতে শক্তিশালী অবস্থানের নির্দেশ দেয়।’
এদিকে চীনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি নভেম্বরে সাত মাস পর প্রথমবারের মতো বার্ষিকভিত্তিতে বেড়েছে, যার পরিমাণ ছিল গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান আইজির বাজার কৌশলবিদ ইয়েপ জুন রং বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম সম্প্রতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। কারণ চীনা কর্তৃপক্ষের শক্তিশালী নীতিগত সংকেতগুলো আবারও ২০২৫ সালে বড় ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য আশা জাগিয়েছে।’
সরকারি উপদেষ্টারা বেইজিংকে আগামী বছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অপরিবর্তিত রাখার সুপারিশ করছেন। তবে তারা আরো বেশি পরিমাণে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রত্যাশিত মার্কিন শুল্কের প্রভাব কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি হ্রাসজনিত চাপ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করবে। ট্রাম্পের শুল্ক হুমকি চীনের শিল্প খাতকে নাড়া দিয়েছে, কারণ দেশটি প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে।
অর্থনীতিবিদরা বেইজিংকে ভোক্তাকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের জন্য আরো বেশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া তারা কর, কল্যাণ ও অন্য নীতিগত পরিবর্তনগুলো দ্রুত কার্যকর করার পরামর্শ দিয়েছেন, যা কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়ক হবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh