সবুজ পাহাড়ে ঝরছে রক্ত

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশকেও শান্তি ফেরেনি সবুজ পাহাড়ে। তিন পার্বত্য জেলায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও এলাকা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে খুন, অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলছে। তবে স্থানীয়রা মনে করেন, শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াতেই এমন ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, পথচারী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। শান্তি চুক্তির দুই দশকে পাহাড়ে একটি আঞ্চলিক সংগঠন ভেঙে চারটি সংগঠন গঠনের পর প্রথমবারের মতো গত ১৮ আগস্ট রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলায় গোলাগুলিতে এক সেনাসদস্য নিহত হন। এসব সহিংস ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে গোটা পাহাড়জুড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে এখন প্রশ্ন উঠছে, কোন পথে এগুচ্ছে পাহাড়ের রাজনীতি! 

জনসংহতি সমিতি ভেঙে চার সংগঠন
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই সময় শান্তিবাহিনীর নেতারা তাদের অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। চুক্তি সম্পাদনকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করেন তৎকালীন জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি প্রসিত খীসাসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। 

পরবর্তী সময়ে এই চুক্তির বিরোধিতা করে সন্তু লারমার সংগঠন থেকে বের হয়ে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে পাহাড়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে এলাকা নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও অপহরণের রাজনীতি শুরু। ক্রমেই সবুজ পাহাড় হয়ে ওঠে অশান্ত। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে প্রাণ হারায় কয়েক হাজার মানুষ।

২০০৭ সালে ফের সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসে অন্তঃকোন্দল দেখা দেয়। জেএসএস প্রভাবশালী নেতা সুধাসিন্দু খীসা, তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলেসহ একটি বিশাল গ্রুপ ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জেএসএসের কর্মকা- বিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা চালায়। ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সুধাসিন্দু খীসা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামে নতুন আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। 

সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামের নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্তঃকোন্দল ও নিজ দলের কর্মী হত্যার অভিযোগ তুলে ইউপিডিএফের সাবেক সশস্ত্র শাখার প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাকে আহ্বায়ক করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠিত হয়। এ নিয়ে পাহাড়ে শান্তি চুক্তির স্বাক্ষরের দুই দশকে জেএসএস ভেঙে চার আঞ্চলিক দল গঠিত হয়।

আঞ্চলিকদলগুলোর সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের সঙ্গে সমঝোতা হয়, যা একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এক দলের হয়ে অন্য দলের নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণা দেখেই প্রমাণ মিলেছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এমএন লারমা) দলের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে। যার প্রভাবও পড়েছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন ও পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে।

আলোচিত হত্যা ও অপহরণ
২০১৭ সালে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আত্মপ্রকাশের পর আলোচিত প্রথম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়ি শহরে। ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সকালে আদালতে মামলার হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফেরেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) অন্যতম সংগঠক মিঠুন চাকমা। দুপুর ১২টার দিকে শহরের গোলাবাড়ি অপর্ণা চৌধুরীপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলে করে চারজন অস্ত্রধারী জোর করে মিঠুনকে একটি মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। পরে ওই এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দূরে স্লুইসগেট এলাকায় মিঠুন চাকমাকে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-কে দায়ী করে ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপ।

২০১৮ সালের ১৮ মার্চ রাঙামাটির সদর উপজেলার কুতুকছড়ি এলাকা থেকে ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক দয়াসোনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের ৩১ দিন পর ১৯ এপ্রিল তারা মুক্তি পান। ইউপিডিএফের এই নেত্রী অপহরণের খবর দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। আলোচিত ওই অপহরণের ঘটনায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-কে দায়ী করে ইউপিডিএফ। মুক্তির পর একই কথা জানান মন্টি ও দয়াসোনা চাকমা।

একই বছরের ৩ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহ-সভাপতি ও নানিয়রচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর দিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগদানের পথেই ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর প্রতিষ্ঠাতা তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ব্রাশফায়ারে পাঁচজন নিহত হন। এই আলোচিত দুই হত্যাকাণ্ডে ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।

২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট খাগড়াছড়ির স্বনির্ভরে ইউপিডিএফ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ইউপিডিএফ (প্রসিত) সমর্থিত তিন পিসিপি নেতা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি তপন চাকমা, পিসিপি সহ-সভাপতি এলটন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা পলাশ চাকমাসহ আরও তিন পথচারী। এই হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রতিপক্ষ জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে ইউপিডিএফ (প্রসিত)।

২০১৯ সালের ১৮ মার্চ রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে দ্বিতীয়ধাপে উপজেলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে ফেরার পথে ব্রাশফায়ারে নির্বাচন কর্মকর্তাসহ আটজনকে হত্যা করা হয়। গত ১২ আগস্ট রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভা এলাকার বাবুপাড়ায় জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহযোগী সংগঠন যুব সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শতসিদ্ধি চাকমা ও বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এনো চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকে দায়ী করে জেএসএস (এমএন লারমা)।

গত ১৮ আগস্ট রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দ্যা ইউনিয়নের পোইথুপাড়ায় সেনা টহলে সন্ত্রাসী হামলায় মো. নাসিম নামে এক সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পাহাড়জুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। কারণ শান্তি চুক্তির স্বাক্ষরের দুই দশক পর প্রথমবারের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়েছে। 

এরপর গত ২৩ ও ২৬ আগস্ট পৃথক দুটি ঘটনায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইউপিডিএফের ‘গোলাগুলিতে’ ইউপিডিএফের চারকর্মী নিহত হন। তবে ইউপিডিএফের দাবি, ‘কথিত গোলাগুলির নাটক সাজিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।’

আত্মগোপনে জেএসএস-ইউপিডিএফ নেতারা
এক সময় খাগড়াছড়ি শহর দাপিয়ে বেড়ানো সংগঠন ইউপিডিএফের নেতাকর্মীরা এখন রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা। গ্রেফতার আতঙ্কে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। অন্যদিকে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতাদের মধ্যেও অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন।

এ ব্যাপারে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের কাম্য নয়। যদি সে অপরাধী হয়ে থাকে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করা হোক। অথচ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হচ্ছে। আজ আমাদের নেতা-কর্মীরা রাস্তাঘাটে বের হতে পারছেন না গ্রেফতারের ভয়ে। যাকে যেখানে পাচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে।’ এ বিষয়ে জানতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ছুফি উল্লাহ বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিছু ঘটনা ঘটছে, সে সব ঘটনায় মামলা হচ্ছে। আমরা অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //