যক্ষ্মা গ্রামের তুলনায় বাড়ছে শহরে

সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে যক্ষ্মা অন্যতম। বাংলাদেশ যক্ষ্মা আক্রান্তের মধ্যে এশিয়ার শীর্ষ ১০ দেশের একটি। এজন্য যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আগামী বছরের মধ্যে ১৫ লাখ যক্ষ্মা আক্রান্তকে শনাক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। সেই সঙ্গে ২০২৫ সালের মধ্যে যক্ষায় ৯৫ শতাংশ মৃত্যু কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এখানে প্রতি বছর ৩ লাখ ৬৪ হাজার মানুষ নতুন করে যক্ষায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া বছরে এক লাখ ২০ হাজার যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসা পায় না বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। 

শহরে ক্রমেই বাড়ছে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা। এক সময় যক্ষ্মা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের রোগ বলে মনে করা হলেও পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বর্তমানে গ্রামের তুলনায় শহরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যক্ষ্মা রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ব্র্যাকের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রধান ডা. শায়লা ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘বিষয়টা এতদিন সংশ্লিষ্টদের নজর এড়িয়ে যাওয়ার কারণেই শহরে যক্ষ্মা রোগী আগের তুলনায় অনেকে বেড়েছে। শহরে হাজার হাজার যক্ষ্মা রোগী এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে যারা রোগটি বয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের মাধ্যমে সংক্রামক এ রোগটি ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। এ কারণে জাতীয় স্বার্থেই নিখোঁজ যক্ষ্মা রোগীদের খুঁজে বের করে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। তা না হলে এমডিআর (ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা) রোগীর সংখ্যা বাড়বে। উল্লেখ্য, যক্ষ্মা রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাস ও হাঁচি-কাশি থেকে যক্ষ্মার জীবাণু অনবরত ছড়াতে থাকে চারদিকে এবং একজন সুস্থ মানুষকে যক্ষ্মায় আক্রান্ত করতে পারে।’ 

দেশে প্রতি বছর ৮০ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যাচ্ছেন। দেশে কার্যকর চিকিৎসা থাকার পরও প্রতি ৪ ঘণ্টায় ৯ জন মারা যাচ্ছেন রোগটিতে। চিকিৎসা থাকলেও যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা খুব সহজ নয়। যক্ষ্মা আক্রান্ত হলে মানুষ অন্যদের বলতে চায় না। মানুষ তাকে এড়িয়ে চলতে পারে এই ভয়ে আক্রান্তরা বলতে চায় না। যক্ষ্মার চিকিৎসাও প্রয়োজন হয় বেশ কয়েক মাস। এর মধ্যে রোগে ভোগার কারণে পরিবারের আয় কমে যায় এবং দারিদ্র্যে নিপতিত হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। কিন্তু এ পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ডা. শায়লা ইসলাম জানান, সরকারকে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মৃত্যু কমিয়ে এবং ৯০ শতাংশ নতুন আক্রান্ত হওয়া রোধ করতে হবে এসডিজি অর্জন করতে হলে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে বাংলাদেশের প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেঁচে যেতে পারে চিকিৎসা খাতে। একই সঙ্গে প্রতিটি যক্ষা রোগীর আয়ু বাড়বে আরো ২৫ বছর। গবষেণা বলছে, যক্ষ্মা রোগীদের জন্য মাত্র ১৫ ডলার খরচ করলে একজন যক্ষ্মা রোগী অতিরিক্ত এক বছর জীবন পেতে পারে। 

যক্ষ্মার ওষুধ সম্বন্ধে শায়লা ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে অধিকাংশ যক্ষ্মা রোগীই কম্বিনেশন ওষুধে সুস্থ হচ্ছে। কিছু যক্ষ্মা রোগী যথাযথভাবে ওষুধ না নেয়ায় মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাচ্ছে, এ রোগীদের সুস্থ করা বেশ কঠিন এবং চিকিৎসায় অনেক খরচও হচ্ছে। অর্ধেক টিবি আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। দরিদ্র মানুষদের বেশি আক্রান্ত করছে এই রোগটি। ধনীদের তুলনায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে টিবি আক্রান্তের হার পাঁচ গুণ বেশি।’ 

শহরের যক্ষ্মা হ্রাস করতে সিটি করপোরেশন এলাকায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চলছে। প্রশিক্ষিত জনবল তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় তারা যথেষ্ট প্রচারণা চালাতে পারছে না। সরকার বিনামূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসা দেয়ায় ধনীদের মধ্যে এ চিকিৎসায় আগ্রহ কম। এসব কারণে শহরে দিন দিন বাড়ছে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা।

বাংলাদেশে কফে জীবাণুযুক্ত ফুসফুসের যক্ষ্মা চিকিৎসায় সাফল্যের হার ৯৪ শতাংশ। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসায় সাফল্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো বলে জানিয়েছেন ফুসফুস বিশেষজ্ঞরা। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসায় বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাফল্যের হার ৫২ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, দেশে নতুন যক্ষ্মা রোগীর হার বছরে প্রতি লাখে ২২৫। বছরে প্রতি লাখে মৃত্যু ৪৫। নতুন যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে এমডিআর টিবিতে আক্রান্তের হার ১.৬ শতাংশ। পূর্বে চিকিৎসাকৃত রোগীদের মধ্যে এমডিআর যক্ষ্মা ২৯ শতাংশ।

ওষুধ সেবনে অবহেলায় যক্ষ্মার জীবাণু ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। সাধারণ যক্ষ্মা ছয় মাসের বিরামহীন চিকিৎসায় সুস্থ হয়। কিন্তু মাঝখানে বিরতি দিয়ে চিকিৎসা নিলে সাধারণ যক্ষ্মার জীবাণুগুলোই ভয়ংকর হয়ে ওষুধ প্রতিরোধী (এমডিআর) হয়ে যাচ্ছে। এমডিআর যক্ষ্মার রোগীকে ১৮ থেকে ২৪ মাস লাগে সুস্থ করতে এবং খরচ হয় দ্বিগুণ, প্রায় ৫ লাখ টাকা। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় চার হাজার ৮০০ মানুষ এমডিআর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। ২০১৪ সালে ৯১৪ এবং ২০১৫ সালে ৮৮০ জন এমডিআর যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট এমডিআর যক্ষায় আক্রান্তরা চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে ডায়াবেটিসের সঙ্গেও যক্ষ্মার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ডায়াবেটিক সমিতির চিকিৎসকেরা গত বছর ১২ লাখ ডায়াবেটিক রোগীর মধ্যে পরীক্ষা করে আড়াই হাজার যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করেছেন। দেশে ৭০ লাখের বেশি ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে। শিশুদের মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্তও বাংলাদেশে কম নয়। গত বছর আট হাজার ১০৩টি শিশু যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছে। যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সরকার প্রতি লাখে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা ১০ জনের নিচে নামিয়ে আনতে চায়। এটা হলে এসডিজি অর্জন সম্ভব হবে এবং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় থাকবে। 

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ যক্ষ্মা আক্রান্ত চিহ্নিত হলেও শনাক্ত করা যায়নি আরও এক লাখ ৩৩ হাজারের বেশি আক্রান্ত। আবার এ সংখ্যার দুই শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়। এদের অনেকে ছয় মাসের পূর্ণ চিকিৎসা নেন না। 

যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ ডা. মজিবুর রহমান জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বছরে চার হাজার যক্ষ্মা আক্রান্তকে খুঁজে পাওয়া যায় না বলে তারা চিকিৎসার বাইরে থেকে যান। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১ দেশে এ ধরনের রোগী রয়েছেন ১০ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে এ অঞ্চলের ১১ দেশে ২ কোটি ৪০ লাখ যক্ষ্মা রোগীকে সুস্থ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ অঞ্চলে বিশ্বের মোট যক্ষ্মা আক্রান্তের ৩৮ শতাংশের বাস। কেবল ভারতেই বিশ্বের মোট যক্ষ্মা আক্রান্তের ২৬ শতাংশ বাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২০১৩ সালে সাড়ে চার লাখ যক্ষ্মা আক্রান্ত মারা গেছেন। যক্ষ্মায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে।

এনটিপির বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন বলেন, ‘সচেতন না হলে সামনে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে। সাধারণ যক্ষ্মা রোগী থেকে এমডিআর হওয়ার পাশাপাশি জীবাণু আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে এবং এমডিআর থেকে এক্সডিআর যক্ষ্মা হয়ে যাচ্ছে। এমডিআর যক্ষ্মার ক্ষেত্রে সাতটি অ্যান্টিবায়োটিকের কম্বিনেশনে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া বিডাকুইনিলন ও ডিলামাইট নামক দুই ধরনের ওষুধ বাজারে এসেছে। এগুলো পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এর বাইরে আর কোনো কার্যকর ওষুধ এখনো বাজারে আসেনি।’ 

যক্ষা বিশেষজ্ঞ ডা. এমএ হামিদ সেলিম জানান, বাংলাদেশে গত তিন বছরে ৯ জন এক্সডিআর যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আশার কথা হলো- উল্লিখিত ৯ জনের মধ্যে ৩ জন সুস্থ হয়েছে। এনটিপি কর্মসূচির আওতায় বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি যক্ষ্মারোগী শনাক্ত করার লক্ষ্যে সরকার শহরের শিল্পাঞ্চল বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিক, বস্তিবাসী ও আশপাশের এলাকা এবং ভাসমান মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //