শহরের চেয়ে গ্রামে বিদ্যুতের দাম বেশি

দেশের গ্রামীণ এলাকার এক কোটি মানুষ শহরের বাসিন্দাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। 

এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্ধারিত মূল্যহারের ফাঁদে পড়ে এ বঞ্চনার শিকার তারা। ফলে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের জনগণকে অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। 

দেশে ছয়টি বিতরণ সংস্থা কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। নিত্য প্রয়োজনীয় এ সেবাপণ্যের খুচরা মূল্যহার ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে চলে আসছে। 

বিইআরসি ঘোষিত ওই মূল্যহার অনুযায়ী, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) মাসে ৫০ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, এমন গ্রাহকদের (লাইফলাইন গ্রাহক) জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সাড়ে ৩ টাকা নির্ধারণ করে। আর্থিক সক্ষমতা কম থাকায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিদ্যুতের ব্যবহার কম। 

বিইআরসি বলছে, শহর এলাকার বাইরে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতায়ন করে আরইবি। প্রয়োজন হলে তারা নির্ধারিত মূল্যহারের চেয়ে বেশি দাম লাইফলাইন গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করতে পারে। 

তবে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘এটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক।’

সারা দেশে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ করে আরইবি। সমিতিগুলোর লাইফলাইন গ্রাহকদের মূল্যহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পল্লী বিদ্যুতের লাইফলাইন গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের গড় দাম পড়ছে ৩ টাকা ৭৮ পয়সা। যেখানে অন্য কোম্পানিগুলো লাইফলাইন গ্রাহকদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ টাকা করে আদায় করছে। কয়েকটি সমিতি আবার প্রতি ইউনিট লাইফলাইন বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৮৭ পয়সা পর্যন্ত আদায় করছে। মাত্র পাঁচটি সমিতি ইউনিট প্রতি সাড়ে ৩ টাকা করে আদায় করছে। এর মধ্যে তিনটি ঢাকার। অন্য দুইটি গাজীপুর ও ময়মনসিংহের। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও এর কাছাকাছি অবস্থিত এ দুই জেলার জনগোষ্ঠীর আয় রাজধানী থেকে দূরে থাকা জেলাগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থেকে বেশি। আরইবির তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে আরইবির আড়াই কোটি গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ৫০ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। এই ৬০ শতাংশ গ্রাহক আরইবির বিক্রিত মোট বিদ্যুতের মাত্র ২৪ শতাংশ ব্যবহার করে। বাকি ৪০ শতাংশ গ্রাহক ৭৬ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। 

কয়েকটি পল্লী বিদ্যুতের মহাব্যবস্থাপক বলেন, মূলত দুইটি কারণে লাইফলাইন গ্রাহকের সংখ্যা এত বেশি। এক. তাদের ক্রয়ক্ষমতা কম। দুই. অনেক এলাকায় লোডশেডিংয়ের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে যায়। 

দেশে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা আরইবি। সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করে এটি। আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন বলেন, ‘বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী সমিতিগুলো লাইফলাইন গ্রাহকদের জন্য মূল্যহার নির্ধারণ করতে পারে। আমরা শুধু নির্দেশনা অনুসরণ করছি।’

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘সরকার গরিব জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অন্যায়ভাবে টাকা আদায় করছে। এ খাতে ৮ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকিসহ ৬০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক বিনিয়োগ রয়েছে। অথচ এই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে সরকারের মোট আয় মাত্র ৩০০ কোটি টাকা। সরকারের জন্য এটি বেশি অর্থ নয়। কিন্তু নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ওই অতিরিক্ত মূল্যের প্রভাব অনেক বেশি। এ প্রেক্ষাপটে গরিবদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি আরও অমানবিক দৃষ্টিকোণের পরিচয় দেয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা প্রায় সময় দাবি করেন তারা গরিব ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের নীতি ও কার্যক্রম ধনী ও করপোরেটদের পক্ষে যায়। ভর্তুকির অর্থ কখনো গরিবের পকেটে যায় না।’

সমিতিগুলোর লাইফলাইন গ্রাহকদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্তত ২৯টি সমিতি লাইফলাইন গ্রাহকদের কাছ থেকে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৮৫ পয়সা রাখছে। এ জেলাগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর ও সুনামগঞ্জ। 

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, এগুলো দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে। দারিদ্র্য ও নদীভাঙনের কারণে জামালপুরের মানুষ প্রতি বছরই ঢাকা বা অন্য কয়েকটি জেলায় স্থানান্তর হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়। জয়পুরহাটেও দারিদ্র্যের হার বেশি। এ জেলায় দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করা অনেক মানুষের কিডনি বা লিভারের একটি অংশ বিক্রি করে দেয়ার তথ্যও বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। 

দেশে সবচেয়ে বেশি লাইফলাইন বিদ্যুৎ বিল দেয় তিনটি জেলার গ্রাহকরা। এগুলো হলো- বরিশাল, চাঁদপুর ও মেহেরপুর। এ জেলাগুলোতে লাইফলাইন গ্রাহকরা প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৮৭ পয়সা দিতে বাধ্য হয়। 

এ প্রসঙ্গে বিইআরসির সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যুতের মূল্যহারে অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টা আমরা করেছি। এজন্য সব কোম্পানির জন্য একই মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু যে গরিবদের জন্য এ নীতি গ্রহণ করা হলো তারাই এর সুফল পাচ্ছে না।’

ব্যবহার অনুযায়ী ছয়টি ধাপে গ্রাহকদের কাছ বিদ্যুৎ বিল নেয় বিতরণ কোম্পানিগুলো। সব ধাপ বিবেচনায় নিলেও দেখা যায়, শুধু লাইফলাইন নয় সার্বিকভাবেও আরইবির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেড়েছে। ২০১৭ সালে বর্ধিত মূল্যহার অনুযায়ী, সব সংস্থা বা কোম্পানির গ্রাহক নির্বিশেষ বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫.৩০ শতাংশ বাড়ে। তবে এগুলোর মধ্যে আরইবির আবাসিক গ্রাহকদের জন্য এই হার সর্বোচ্চ ৮.২৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটি দাম বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার। 

অথচ ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম বেড়েছে সবচেয়ে কম। ডিপিডিসির গ্রাহকদের বিদ্যুতের মূল্য সর্বোচ্চ ২.২৯ শতাংশ ও ডেসকোর গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ১.৫২ শতাংশ বেড়েছে। এ বৃদ্ধি ও অসঙ্গতি সত্ত্বেও ফের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে কোম্পানিগুলো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //