সড়ক পরিবহন আইনের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ

বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর হয়েছে মাসের শুরুতে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা দিয়েছে বিপত্তি। পরিবহন মালিকরা আইনের কিছু ধারা সংশোধনের দাবি তুলে আন্দোলনের পথে রয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্নস্থানে প্রায় প্রতিদিনই বাস চলাচল বন্ধ রাখছেন পরিবহন মালিকরা। পণ্যবাহী যান চলাচল প্রায় বন্ধ। অচলাবস্থা সৃষ্টি হলেও, সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আইন সংশোধনের কোনো সম্ভাবনা নেই। 

আইনে ত্রুটি থাকায় বাস্তবায়নেও রয়েছে বিপত্তি। প্রায় আট বছর ধরে আলোচনা-পর্যালোচনা করে খসড়া প্রণয়ন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, ভেটিং, স্থায়ী কমিটির যাচাই-বাছাই, সংসদে পাস, এরপর  গেজেট জারিসহ সব ধাপ পেরিয়ে বাস্তবায়নের পর্যায়ে এসে আইনে ছয়টি ত্রুটি ধরা পড়েছে। কার্যকরের পর মালিকদের আন্দোলন, গাড়ি বন্ধ রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি—এসব কারণে আইনের ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা।

বিধিমালা প্রণয়ন না করেই গত ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হয় গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী নজিরবিহীন আন্দোলনের ফলে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন। এতে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গে সাজা বেড়েছে বহু গুণ। জরিমানা বেড়েছে হাজার গুণ পর্যন্ত। যততত্র রাস্তা পারাপারের সাজা ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে নতুন আইনে। গাড়ির আকৃতি পরিবর্তনে ধার্য করা হয়েছে এক থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানা। অতিরিক্ত পণ্য বহনে একই পরিমাণ জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাদায়ে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩-তে এই দুই অপরাধের জরিমানা ছিল দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। 

মোটরযান অধ্যাদেশে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। নতুন আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা এবং ছয় মাস কারাদ-। ভুয়া লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশনে গাড়ি চালানোর সাজা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা বা দুই বছর জেল অথবা উভয় দ-। আগের আইনে রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি চালানোর সাজা ছিল সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা জরিমানা ও তিন মাস কারাদণ্ড। ফিটনেসবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে একই পরিমাণ সাজা ভোগ করতে হতো। নতুন আইনে রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ছয় মাস জেলের বিধান রয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর সাজা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। 

আইনটিকে কঠোর বলছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। গত বছরের ৮ অক্টোবর গেজেট জারির পর থেকেই তারা সংশোধনের দাবি তুলেছিলেন। ৬৪টি সুপারিশ দিয়েছিলেন তারা। এসব আমলে নেয়নি সরকার। পরিবহন নেতারা বলছেন, নতুন আইনে যেভাবে জেল-জরিমানা বাড়ানো হয়েছে, তাতে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। 

এই আইনকে পরিবহন মালিকরা কঠোর বললেও, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা নাগরিক সমাজ আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন। সড়ক পরিবহন আইনের দাবিতে ২০১৩ সালে শহীদ মিনারে অনশনে বসেছিলেন কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকুসদ। আইন প্রণয়নেও জড়িত জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এই সদস্য। তিনি বলেছেন, ‘আইন ভালো হয়েছে। তবে কার্যকরের আগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আস্থায় নেওয়া উচিত ছিল। তাদের বোঝানো দরকার ছিল, আইন মেনে চললে কিছুই হবে না। এই আইন মেনে চলা সম্ভব। হুট করে কার্যকর করায় শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।’

নতুন আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত ধারা অমান্যে জরিমানা ২৫ হাজার টাকা। দুই বছর পর্যন্ত জেলেরও বিধান রয়েছে। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, ‘দেশে প্রায় ১০ লাখ চালকের ঘাটতি রয়েছে। বহু চালক হালকা গাড়ির লাইসেন্স নিয়ে ভারী গাড়ি চালান। সংকটের কারণে তারা বাধ্য হয়েই চালান। এখন যদি চালকদের ধরে ধরে জেলে নেওয়া হয়, তাহলে গাড়ি কে চালাবে?’ তাই সড়ক পরিবহন আইনের সব ধারা জামিন যোগ্য করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। 

নতুন আইনের ৯২, ৯৫ এবং ১০৫ ধারা জামিন অযোগ্য। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন উপ-কমিটির সভাপতি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘যা হওয়ার হয়েছে। ত্রুটি থাকলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা দাবি নিয়ে আসুক। সরকার প্রয়োজন মনে করলে বিবেচনা করবে। সংশোধন দরকার হলে সংশোধন হবে। আর কোন ধারার মামলার জামিন হবে, কোনটিতে হবে না—তা আদালতের সিদ্ধান্ত। এখানে সরকারের কিছু করার নেই।’ 

আইন ঠিকঠাক কার্যকরের আগেই তা সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন, শ্রমিকদের অসন্তোষকে ভালো লক্ষণ বলে মনে করছেন না গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘এর মাধ্যমে আইনের উদ্দেশ্যই ঝুঁকিতে পড়েছে। পরিবহন মালিক শ্রমিকরা আইনের সবচেয়ে বড় অংশীজন।’ 

তবে এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নিরাপদ সড়ক চাইর (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেছেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলেই, মালিক-শ্রমিকরা গাড়ি বন্ধ করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করেন। সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে, তাদের দাবি আদায় করে। আইন প্রণয়নে মালিক শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের দাবি-দাওয়া তখনই মানা হয়েছে। এরপরও কোনো দাবিদাওয়া থাকলে, তা তারা সরকারকে জানাতে পারে। অনেক উপায় আছে দাবি জানানোর। গাড়ি বন্ধ করা সমাধান নয়।’ 

ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি হাজী তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, ‘সরকার তাদের দাবি শুনছে না। তাই তারা বাধ্য হয়েই আন্দোলনের দিকে গিয়েছেন। এ ছাড়া আর পথ নেই। নতুন আইনের অধীনে জেল জরিমানার ভয় মাথায় নিয়ে চালকরা গাড়ি চালাতে চায় না। মালিকদের কিছুই করার নেই।’ 

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, ‘আইনে অনেক ত্রুটি রয়েছে। এত ত্রুটি রেখে যে আইন কার্যকর করা হয়েছে, তাতে মালিক-শ্রমিকদের জন্য ভালো কিছু হবে না। যাত্রীদের জন্যও ভালো কিছু হবে না। মালিক-শ্রমিকদের শাস্তি দিয়ে সড়কে স্বস্তি আসবে না।’ 

বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেছেন, ‘নতুন আইনে চালকের সহকারীর লাইসেন্স না থাকলে ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এখনো লাইসেন্স প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। লাইসেন্স দেওয়ার আগেই জরিমানা নির্ধারণ করা কোনো ভালো কাজ নয়। এভাবে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না।’ 

বিআরটিএর চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেছেন, ‘আইনে সংশোধন আসবে কি না, তা সরকারের সিদ্ধান্ত। বিআরটিএর দায়িত্ব সরকার যে আইন করেছে, তা প্রয়োগ করা। এতে কোনো সংকট হলে সরকার সমাধান করবে। কিন্তু গাড়ি বন্ধ রাখা সমাধান নয়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //