পুরনো গাড়ি রূপ পাল্টিয়ে অ্যাম্বুলেন্স

‘কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করা ঠিক নয়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাম্বুলেন্স যথাসময়ে পৌঁছায় না।’ ভারতের বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবি শেঠির এ কথাটা জানা থাকলে, হয়তো এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হতো না নুরুন্নাহার রানিকে।

এক দুপুরে হঠাৎ বাসায় জ্ঞান হারান রাজধানীর বাড্ডা এলাকার এই গৃহবধূ। ঘরে তখন কেউ নেই, জ্ঞান ফিরে দেখেন বাথরুমের মেঝেতে শুয়ে আছেন। ঘণ্টা তিনেক পর স্বামী বাসায় ফিরলে সব খুলে বলেন। তাকে পাড়ার এক ডাক্তারের চেম্বারে নেওয়া হয়। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানান, বয়স পঁয়তাল্লিশের ওই নারী হার্ট অ্যাটাক করেছেন। তাকে দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিতে হবে। কালবিলম্ব না করেই ডাকা হয় অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু অতিজরুরি সেই গাড়ির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা এবং মাঝপথে বিকল হয়ে পড়ায় রোগীকে নিয়ে সময় মতো হাসপাতালে পৌঁছতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এমন অনেক বাজে অভিজ্ঞতা ও রাগ-ক্ষোভের কথা শোনা যায়। 

নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই দীর্ঘদিন ধরে রোগী পরিবহনের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একটি অসাধু চক্র। পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মাইক্রোবাস ও মালবাহী পিকআপকে রূপান্তর করা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। এমনকি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তপক্ষের (বিআরটিএ) কোনো অনুমোদনও নেওয়া হয় না। অনেক স্থানেই ‘চ’, ‘গ’, ‘ব’, ‘শ’ ও ‘ঠ’ সিরিয়ালের অ্যাম্বুলেন্স নম্বর দেখা যায়। অথচ বিআরটিএ বলছে, ‘ঠ’ সিরিয়ালে পিকআপের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়, ‘শ’ সিরিয়াল রেফ্রিজারেটর ভ্যানের এবং ‘গ’ প্রাইভেটকারের। অ্যাম্বুলেন্সে রেজিস্ট্রেশনকৃত গাড়িগুলোতে ‘ছ’ দিয়ে সিরিয়াল নম্বর শুরু হয়। তার মানে অন্য সিরিয়ালের অ্যাম্বুলেন্সগুলো বিভিন্ন ধরনের গাড়ি থেকে রূপান্তর করা, যা বেআইনি।

এমনকি ব্যক্তি মালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার নিয়ম নেই। বিআরটিএ কেবল সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানকেই রোগী পরিবহনের গাড়ি পরিচালনার নিবন্ধন দেয়। আর নিয়মানুযায়ী অ্যাম্বুলেন্সে রাখতে হয় স্থায়ী শয্যা, চিকিৎসক বসার আসন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক, স্ট্রেচার ও সাইরেন এবং রোগীর মাথা রাখার অংশে থাকতে হবে রিভলভিং চেয়ারের মতো ব্যবস্থা। চালক, চিকিৎসক, রোগীর স্বজনসহ ছয়জনের অতিরিক্ত আসন বসানো যাবে না। কিন্তু সিন্ডিকেট পরিচালিত অ্যাম্বুলেন্সে বেশিরভাগ শর্তই মানা হয় না। আবার উল্টোটাও হচ্ছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যাম্বুলেন্সকে অবৈধভাবে মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন নেওয়া হচ্ছে বিআরটিএ থেকে। মূলত, শুল্ক ফাঁকি দিতেই সংস্থাটির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ কাজ করছেন কিছু আমদানিকারক। কারণ মাইক্রোবাস আমদানিতে যে পরিমাণ শুল্ক গুনতে হয়, অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে দিতে হয় তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ।

হাসপাতাল কর্মচারীদের অবৈধ ব্যবসা

বিধি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যবসা করতে পারেন না। অথচ হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি কেউ কেউ ছেলে, স্বামী, ভাইয়ের নামে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চাইলে চালক শোনাচ্ছেন বিভিন্ন সমস্যার কথা। কখনো তেল সংকট, কখনো বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্টসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে সেগুলো বন্ধ রাখা হয়। বেসরকারি পরিবহনে রোগী আনা-নেওয়ায় সাধারণরা গুনছেন কয়েকগুণ বেশি টাকা।

সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল), মিটফোর্ড হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট, শিশু হাসপাতাল, মুগদাসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের আশপাশের রাস্তায় নানা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে অসংখ্য অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং করা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এ ব্যবসা। নিজেদের গাড়িতে তুলতে রোগী ও লাশ নিয়ে তাদের টানাহেঁচড়া নিত্য ঘটনা। 

সবচেয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি ঢামেক হাসপাতাল ঘিরে। জরুরি বিভাগের সামনে দিন-রাত সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে ২০ থেকে ২৫ জন দালাল। তাদের বাইরে কেউ অ্যাম্বুলেন্স নিতে পারেন না। পরিচয় গোপন করে দীর্ঘ আলাপকালে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স মালিক জানান, হাসপাতালের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কিছু অসাধু কর্মচারী এ সিন্ডিকেটের সদস্য। এদের বেশিরভাগই পুরনো মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে ব্যবসা করছেন। আর তাদের কাছ থেকে সরকারি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মী, পুলিশ কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারা পান।

গাড়ি কোথায় অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা যায়, প্রশ্ন করতেই একটু নড়েচড়ে বসেন মো. ফারুক নামে এক কর্মচারী, ‘তা দিয়ে আপনে কী করবেন?’ নিজের ক্লিনিকের জন্য তৈরি করব, শোনার পর একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে যান। তিনি জানান, ঢাকার অনেক গ্যারেজেই তাদের লোক রয়েছে। গাড়ি পাঠিয়ে দিলে তা অ্যাম্বুলোন্সে রূপান্তর করে দেয়। গাড়ির কন্ডিশন বুঝে খরচ। সাধারণত এক থেকে দুই লাখ টাকা লাগে। কথার এক পর্যায়ে পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে ফারুক বললেন, ‘কারিগররে আমার কথা কইয়েন, ট্যাকা কম রাখব। তয় বিষয়ডা কিন্তু গোপন!’ সেই সূত্র ধরে বিভিন্ন গ্যারেজ ঘুরে জানা যায়, পুরনো গাড়ি মেরামত করে অ্যাম্বুলেন্সে পরিবর্তনের সময় সবার আগে সাইরেন হর্ন লাগানো হয়। কারণ রাস্তায় পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্সকে মানবিক কারণে ছেড়ে দেয়, ভেতরে কী রয়েছে তা দেখে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢামেকের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারী অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এসব নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের সমিতিও আছে। এমনকি মর্গ থেকে মরদেহ নেওয়ার সময় তাদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার না করলে ছাড়পত্রও দেওয়া হয় না। আবার তাদের গাড়ি নিলে ভাড়া গুণতে হয় অতিরিক্ত।

হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে অসুস্থ থাকায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এখানে আছি। তাই হাসপাতালের নাড়ি-নক্ষত্র জানা হয়ে গেছে। আ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এখানে দালালরা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে যে আচরণ করে, তা বলার মতো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব জেনেও নীরব।’ ঢাকার বাইরের জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোর চিত্রও প্রায় একই। 

এ বিষয়ে নাগরিক স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের নেতা ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘পুরনো গাড়িকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর প্রচণ্ডভাবে অন্যায়। একেবারেই বেআইনি। কেননা অ্যাম্বুলেন্সের গতি কখনো কখনো জীবনের সমার্থক, অর্থাৎ একজন হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে যতদ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো যাবে, তাকে বাঁচানোর সম্ভাবনাও তত বেশি। কিন্তু পুরনো গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স হলে তা মাঝপথে বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন রোগীর জীবন সংকটে পড়ে।’

লক্কড়-ঝক্কড় সরকারি গাড়ি

সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের স্বল্পতা আর দূরে পরিবহনে চালকের অনীহার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে অসাধু গাড়ি ব্যবসায়ীরা। তখন সিন্ডিকেটের দেওয়া সিরিয়ালের গাড়িই নিতে হয় অতিরিক্ত ভাড়ায়। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটাতে চাইলে হতে হয় নাজেহাল। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় বিষয়টি সামনে আসে। দিন কয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার গুরুতর অসুস্থ হলে নেওয়া হয় সদর হাসপাতালে। চিকিৎসকের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানোর কথা বলা হয়। ডাকা হয় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। সেটির অবস্থা ভালো না থাকায় আরেকটির জন্য যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ‘সিরিয়াল’ অনুযায়ী এটাতেই যেতে হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এ ঘটনায় আল-মামুন সরকার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমার মতো একজন যখন এমন হয়রানির শিকার হয়, তখন সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তা বুঝাই যায়।’

সড়কে চলন্ত বোমা

সিএনজিতে চলা অনুচিত হলেও বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সই সিএনজিচালিত। আর এসব গাড়িতে ব্যবহার করা মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার পরিণত হয়েছে একেকটি চলন্ত বোমায়। গত ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় রোগী বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্সের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারে তিনজন নিহত হন। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের দেশের অধিকাংশ সিলিন্ডার বিদেশ থেকে আমদানি করা। মূলত অসতর্কতা এবং অজ্ঞতার কারণে যেনতেনভাবে তা ব্যবহারের কারণে আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই যেসব সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ, সেগুলো বাদ দেওয়া উচিত। এখন কেউ যদি বাদ না দিয়ে ব্যবহার করেন, তখন তো দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সব পক্ষকেই সতর্ক হতে হবে। বেশি সচেতন হতে হবে ব্যবহারকারীকে।’

নেই কোনো নীতিমালা

দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে ‘অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার নীতিমালা’। ফলে সাধারণ গাড়ির মতোই অ্যাম্বুলেন্সকে লাইসেন্স দিচ্ছে বিআরটিএ। এর জন্য বিশেষ কোনো অনুমোদন নিতে হয় না। অথচ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এর সঙ্গে যুক্ত নয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় বা এর কোনো দপ্তর। কিছু শর্ত পূরণের কথা থাকলেও কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করলেই চলে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে অসাধুরা। বর্তমানে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির তত্ত্বাবধানে রয়েছে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান, তাদের রোগী পরিবহনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের মতো। এগুলোর উপর সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বা মনিটরিংও নেই। ফলে জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। 

পরিবহন বিশেষজ্ঞ মারুফ রহমান বলেন, ‘১৯৮৩ সালের মোটরযান বিধিতে অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধনের আলাদা নিয়ম নেই। যদিও নিবন্ধনের আওতায় দেশে ২০ ধরনের সড়ক পরিবহনের মধ্যে সবার প্রথমেই রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের নাম। এ সমস্যার সমাধান করাও জরুরি। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোগী ও লাশ পরিবহনের গাড়িগুলোর জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।’

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //