দক্ষিণ এশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে বৈধ করেছেন মোদি

বিগত ৫০ বছর ধরে ভারত আর বাংলাদেশ বন্ধু হিসেবে চলে আসছে। কিন্তু এখন এটা পরীক্ষার মুখে পড়েছে। 

এটা খালেদা জিয়া/বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আমলের উত্তেজনা নয় বরং আরো ব্যাপক ও অরাজনৈতিক কারণে এই উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, যার পেছনে রয়েছে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) ও ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি)। 

সিএএ ও এনআরসি সরাসরি বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক মিডিয়া- সবখানেই সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের ভেতর থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছে, সেটা তাদের ধারণায় ছিল না। আর প্রতিবাদকারীরা শুধু মুসলিম নন। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, দলিত, সবাই এখানে সমান উদ্দীপনা নিয়ে প্রতিবাদে নেমেছেন। 

অখুশী মানুষদের মধ্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীও রয়েছে। তারা হলো- দরিদ্র আর অধিকার কর্মীরা, আর বয়স্ক থেকে তরুণ সবাই আছেন এর মধ্যে। তাই মোদি তার দলের কর্মীদের বস্তিগুলোতে পাঠিয়েছেন, যাতে দরিদ্র মানুষদের (যারা এখন উদ্বিগ্ন ও হতভম্ব অবস্থায় আছে, কারণ তাদের খুব অল্পসংখ্যক মানুষেরই কাগজপত্র রয়েছে) বলা হয় যে, সিএএ আর এনআরসির কারণে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।

আইন প্রণয়নের আগে আতঙ্ক নিরসনের চেষ্টা করা হলে সেটা ভালো হতো। বিরোধী দলগুলো জনগণের অসন্তোষকে পুঁজি করে এরই মধ্যে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ভিম আর্মির মতো দরিদ্র (দলিত) অধিকার গ্রুপগুলোও এখন সক্রিয় হয়ে গেছে।

অধিকার কর্মীরা অনেক দিন ধরেই রাষ্ট্রকে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে আর এখন তারা একটা ইস্যু পেয়েছে, যেখানে বহু শ্রেণির মানুষের সামাজিক সমর্থন রয়েছে। 

সিএএ ও এনআরসির কারণে মুসলিমরা সন্দেহাতীতভাবে হুমকির মুখে পড়ে গেছে, কিন্তু এখন তারা নিজেদের বিশ্বাসকে অস্বীকার না করেও সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করছে, যেটা এই সমস্যাটিকে একটা ধর্মীয় চেহারা দিয়েছে, যেটা ভারত কখনো চায় না। প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের শক্তিশালী জনগোষ্ঠী মুসলিমদেরকে অবজ্ঞা করার উপায় নেই।

এটা শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যাও নয়, কারণ ভারতের কাছের ও দূরের প্রতিবেশীরাও এটা নিয়ে অখুশি। এমন সময় এটা আনা হলো যখন বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি দুর্বলতম অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে এতে ভারতের আন্তর্জাতিক ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশানের (ওআইসি) মতো কিছু গ্রুপের সঙ্গে তাদের ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর এর প্রভাব পড়বে বহুমুখী।

বাংলাদেশ দৃষ্টিকোণ

সিএএতে যে তিনটি দেশের নাম রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ সামান্য। সে কারণে এটা কার্যত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা নির্যাতনের অভিযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু স্কলার আবার এটাকে সমর্থন করেছেন। 

বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের প্রবাসী গ্রুপগুলোও দাবি করেছে যে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যায় জোরপূর্বক অভিবাসন করানো হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সবখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিষয়টি অভিন্ন ইস্যু। অধিকাংশ সরকার অবশ্য বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে, কিন্তু সিএএ এই কার্যকর মডেলটার ক্ষতি করেছে। এভাবেই মোদি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে বৈধতা দিয়েছেন। 

আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারত ‘সামাজিক ভারসাম্য’ মডেলকে সমুন্নত রেখেছিল, কিন্তু এখন এটা হুমকির মুখে পড়ে গেছে। সিএএ এখন দক্ষিণ এশিয়াতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।

বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেছেন, এর ক্ষতিটা হবে ত্রিমুখী- ‘প্রথমত, ভারতবিরোধী মনোভাব আরো বাড়বে। দ্বিতীয়ত, সরকারবিরোধী জনমত বাড়বে, এবং এটা তাদেরকে উৎসাহিত করবে যারা দাবি করে যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতের পকেটের মধ্যে রয়েছে। আর তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের ওপর এটা সত্যিকার নেতিবাচক একটা প্রভাব ফেলতে পারে। আমার বিবেচনায়, এই শেষের বিষয়টি সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।’

আর এই প্রভাব মোকাবেলায় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য শেখ হাসিনার ওপর চাপ বাড়তেই থাকবে। কিছু পুশ-আউটের ঘটনা এরই মধ্যে ঘটেছে এবং মিডিয়া সেগুলো প্রচারও করেছে। বাংলাদেশ সরকার বলেছে যে, প্রকৃত বাংলাদেশিদেরকেই শুধু তারা গ্রহণ করবে এবং বাকিদের ফেরত পাঠাবে। সে কারণে এটি একটি জীবন্ত ইস্যু।

কৌশলগত ইস্যু

পরিস্থিতি বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললে দুটো ইস্যু আরো প্রকট হয়ে উঠতে পারে। একটি হলো- ভারতে অস্থিরতার একটা বড় অঞ্চল হবে সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলো বা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এই অঞ্চলগুলো একই সঙ্গে বাংলাবিরোধীও বটে।

তারা যদি আবার গেরিলা তৎপরতা শুরু করে এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে, তাহলে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজতে পারে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গেরিলাদেরকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে বাংলাদেশ এবং বিষয়টি নিয়ে দিল্লি খুশি।

আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় বা সহায়তা দেবে না ঠিক, কিন্তু দেশের ভেতরের কিছু পক্ষ এই সহায়তা দেয়ার জন্য প্ররোচিত হতে পারে এবং তারা এ ক্ষেত্রে জনগণের সমর্থনও পাবে। এটা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। 

বাংলাদেশ ইসলামিক জঙ্গিদের আশ্রয় দেবে না, কারণ তারা বাংলাদেশেরও শত্রু। কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গেরিলাদের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হবে।

শ্রেণি ও চীন

যেহেতু সীমান্ত পারাপারের সঙ্গে নিম্নশ্রেণির মানুষ জড়িত থাকে ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাতায়াত হয় মূলত শপিং আর চিকিৎসা সহায়তার জন্য, সেক্ষেত্রে ভারতে যাতায়াতের দাবির বিষয়টি একটা সমস্যা হতে পারে। দরিদ্ররা যদিও আয় করতে যায়, কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরো ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী হয়ে উঠছে, যদিও তারা সেখানে যায় মূলত ব্যয় করতে।

ভারতের ভিসা ব্যবস্থা এখন যথেষ্ট প্রশস্ত, কিন্তু বাংলাদেশ যদি ‘অবন্ধুসুলভ’ রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, এই নীতি সেক্ষেত্রে বদলে যেতে পারে। কারণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি আবেগনির্ভর হয়ে উঠেছে। ভারত যদি সেটা করে, তাহলে বাংলাদেশের সামনে ভারতীয় পণ্যের বিকল্পের সন্ধান করার সুযোগটা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এখনই ভারত বাংলাদেশের এক নম্বর বাণিজ্য অংশীদারের জায়গা থেকে সরে গেছে। এখন শীর্ষে রয়েছে চীন।

ভারতের নীতির কারণে ঠিক সেই জিনিসটাই ঘটবে, যেটা ভারতের সবচেয়ে বেশি অপছন্দের- সেটা হলো চীন এখানে লাভবান হবে। চীন খুব বেশি কিছু করছে না, কিন্তু ভারতের নীতিই চীনকে এ অঞ্চলে অনেক প্রভাবশালী করে তুলছে। চীনের প্রভাব এখানে স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে এবং ভারতকে এটা খুঁজে বের করতে হবে যে, তাদের নীতির কারণে বন্ধু ও শত্রু - উভয়ের দিক থেকেই যে প্রতিক্রিয়া আসছে, সেটা ঠেকাতে তারা কি করবে।

সৌজন্যে: সাউথ এশিয়ান মনিটর

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //