অপার সম্ভাবনার কচুরিপানা

জলের জঞ্জাল কচুরিপানা। ডোবা-নালা, খাল-বিল ও নদীতে দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদটির বিড়ম্বনা সবার জানা। 

নৌযান চলার পথকে রুদ্ধ করা, মাছের উৎপাদন হ্রাস ও জলাবদ্ধ জমিতে ফসল উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটাতে এর জুড়ি নেই। 

বহুল পরিচিত ভাসমান এই গুল্মটি কিন্তু এ দেশের নয়। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্কিডপ্রেমী এক পর্যটকের কাছে কচুরিপানার ফুলগুলো এতটাই ভালো লাগে যে, তিনি ব্রাজিল থেকে এ দেশে নিয়ে আসেন। 

আবার এটাও শোনা যায়- ঔপনিবেশিক সময়ে কোনো এক মেমসাহেবের কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল পছন্দ হওয়ায় সেটা ভারতীয় উপমহাদেশে আনা হয়। সে যা-ই হোক, নদীমাতৃক বাংলাদেশ কচুরিপানা বিস্তারের জন্য একেবারে উপযুক্ত আবাসস্থল বলা চলে। এরা এত তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে, যা কল্পনাতীত- জ্যামিতিক গতিকেও হার মানায়। 

তাই ১৯২০ সাল নাগাদ দেশের নদী-নালাসহ প্রায় নব্বইভাগ জলাশয় কচুরিপানায় ছেয়ে যায়। এতে নৌ-চলাচল ব্যাহত হতে থাকে। ওপরের পৃষ্ঠ ঢেকে দেয়ায় সূর্যালোক না পেয়ে পানির নিচের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মারা যেতে থাকে মাছ। নিচু জমিতে ধান ও পাটের আবাদস্থলেও বেড়ে যায় এর দৌরাত্ম্য। আর এতে ভেঙে পড়ে বাংলার কৃষিপ্রধান অর্থনীতি। তাই কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণে তখন সংশোধন করা হয় বেশ কিছু আইন। সেই সঙ্গে ১৯৩৬ সালে ‘কচুরিপানা আইন’ করে একে নির্বংশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর পরের বছর জাতীয় নির্বাচনে সব দলের ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানা মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি আসে। বিজয়ী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সরকার গঠনের পরপরই সেই কাজটি হাতে নেন। এ কর্মসূচি সফল তো হয়েছিলই, এর সঙ্গে উন্মুক্ত হয় এক নতুন সম্ভাবনা। স্তূপকৃত পচা কচুরিপানাকে সার হিসেবে ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো হয় ফসলের।

দেশের জলে যেমনই থাকুক, এখন মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে কচুরিপানা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গবেষকদের উদ্দেশে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘কচুরিপানা নিয়ে কিছু করা যায় কি না দেখেন। এর পাতা খাওয়া যায় না কোনো মতে? গরু তো খায়। গরু খেতে পারলে আমরা খেতে পারব না কেন? আমি জানি না, বিষাক্ত কোনো ব্যাপার আছে কি না।’ 

মন্ত্রীর এ বক্তব্য হইচই ফেলে দেয়, কিছুটা বিকৃত হয়ে ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিষয়টি সংসদ পর্যন্ত গড়ায়। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কাগজে দেখলাম আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী কচুরিপানা খেতে বলেছেন। কচুরিপানা খেতে হবে কেন, আমাদের দেশে কি দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে?’ 

বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘প্রতিদিন নতুন নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন হচ্ছে। আগে মাশরুম দেখলে বলা হতো ব্যাঙের ছাতা, নিষিদ্ধ খাবার। এখন তা খাওয়া হয়। হয়তো এমন দিন আসবে, কচুরিপানা থেকেও খাবার আবিষ্কৃত হবে।’ 

নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনামন্ত্রীও বলেছেন, ‘কচুরিপানা খাওয়া যায় কি না, এটা নিয়ে কৃষি গবেষকদের গবেষণা করতে বলেছি। সরাসরি কাউকে কচুরিপানা খেতে বলিনি। আমার বক্তব্য কিছু মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’

জলে ভেসে খায় বিষ

যেকোনো পরিবেশেই কচুরিপানা জন্মাতে পারে, এমনকি বিষাক্ত পানিতেও বেড়ে ওঠে স্বমহিমায়। মার্কারি ও লেডের মতো বিষাক্ত পদার্থ এরা শিকড়ের মাধ্যমে পানি থেকে শুষে নিতে পারে। 

আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী সত্তরের দশকে দেখিয়েছিলেন, কলকারখানার দূষিত পানি থেকে কচুরিপানার শিকড় একদিনের মধ্যেই শুষে নিতে পারে নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের শতকরা ৯৭ ভাগ। নানা ভারী ধাতু কিংবা জৈবিক অপদ্রব্যও নিষ্কাশন করে সেই পানিকে অন্তত ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ দূষণমুক্ত করতে পারে জলেভাসা উদ্ভিদটি।

পাকোড়া, স্যুপ, অমলেট আরো কত কী

কচুরিপানা নিয়ে আমরা যখন নাক ছিটকাচ্ছি, তখন শীতপ্রধান দেশ জার্মানিতে এর চাষ নিয়ে চলছে রীতিমতো গবেষণা। জলজ এই উদ্ভিদটির একটি প্রজাতি হচ্ছে ক্ষুদিপানা বা তেঁতুলপানা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ডাকউইড। এর রয়েছে অসাধারণ পুষ্টিগুণ। 

জার্মানির উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ক্লাউস আপেনরোট বলেন, ‘ডাকউইড গোত্রের সব উদ্ভিদই অবহেলিত। অথচ মানুষের পুষ্টির ক্ষেত্রে এগুলো অভাবনীয় অবদান রাখতে পারে। সব ডাকউইড প্রজাতির মধ্যে প্রোটিনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি, শুকনো অবস্থায় যা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। অ্যামিনো এসিডের মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর অনুপাতও খুবই ভালো।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষুদিপানার নিজস্ব কোনো স্বাদ নেই বলা চলে। ফলে এতে সুবিধা হলো, সব ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগানো যায়। খাদ্য হিসেবে এটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। অমলেট কিংবা স্মুদি হিসেবে তা খাওয়া সম্ভব। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকায়ও এমন পদ যোগ হবে। অবশ্য থাইল্যান্ড ও লাওসে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরেই খাদ্য হিসেবে ক্ষুদিপানাকে কাজে লাগানো হয়।’ 

রন্ধন বিশেষজ্ঞরা জানান, কচুরিপানা দিয়ে অনেক মজাদার খাবার বানানো সম্ভব। কম্বোডিয়ায় কচুরিপানার কাণ্ড আর ফুল ব্যবহার করে মাছের স্যুপ তৈরি হয়, যা তাদের নিত্যদিনের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর কচুরিপানা ফুলের কুড়মুড়ে পাকোড়া তো আমাদের গ্রামাঞ্চলেও বেশ জনপ্রিয়। তবে শুধু স্বাস্থ্যকর খাবারই নয়, এটি সুপার ফুড হিসেবেও বিবেচিত।  

মাটির খাঁটি খাবার

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে উদ্ভিদটি নিয়ে গবেষণা করছেন। 

তিনি জানান, পানির বিষাক্ততা ও দূষণ কমাতে কচুরিপানার চাষ অত্যন্ত উপকারী। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় এটিকে শুকিয়ে মালচ হিসেবে ব্যবহার করে লবণাক্ততা কমিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সম্প্রতি ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচোসার) তৈরির মাধ্যম হিসেবেও কচুরিপানা নানা দেশে প্রমাণিত হয়েছে। এটি থেকে তৈরি জৈব সার ব্যবহার করে জমির উর্বরতা ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাফল্য পাওয়া গেছে। 

তিনি জানান, ১৮০ টন কাঁচা কচুরিপানা থেকে প্রায় ৬০ টন জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। কৃষকের গোয়ালে গরু না থাকায় দেশে দিন দিন গোবরের প্রাপ্যতা কমে আসছে। সে ক্ষেত্রে কচুরিপানার তৈরি সার খুবই উপযোগী। গুল্মটি প্রাকৃতিকভাবে পানি থেকে বেশ ভালোভাবেই নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ করতে পারে। এসব উপাদান মাটির পুষ্টিগুণ বাড়ায়। 

ভারতের তামিলনাড়ুর গবেষক সেলভারাজ জানান, ভার্মি কম্পোস্টের জন্য যেখানে অন্যান্য কৃষিবর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করতে ৭০ দিন সময় লাগে, সেখানে কচুরিপানায় লাগে ৫৫ দিন। 

মনকাড়া ফার্নিচার

কচুরিপানার এক অভিনব ব্যবহার হলো ফার্নিচার তৈরি। এগুলো যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় অবশ্য বেতের ফার্নিচার মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো বেতের তুলনায় অনেক বেশি নরম, স্থিতিস্থাপক ও আধুনিকতার প্রকাশ ঘটায়। উন্নত বিশ্বে কচুরিপানার ফার্নিচারের রয়েছে বেশ কদর। এছাড়াও কচুরিপানার লেডিস হ্যান্ডব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, ফুলদানি, পেন হোল্ডার, সাহেবী টুপি, ঝুড়ি পণ্য, হাঁড়ি, কাপ-পিরিচ, চামচ জাতীয় শোপিস তৈরি হচ্ছে দেশে। 

এ বিষয়ে যশোরের তরুণ উদ্ভাবক সাঈদ হাফিজ বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে কচুরিপানা নির্মূলে চেষ্টা চললেও তা সফল হয়নি। তাই উদ্ভিদটিকে কাজে লাগানোর ভাবনা থেকে গবেষণা শুরু করি। আমার এই উদ্ভাবনে কচুরিপানাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফাইবার (সুতা) তৈরি করে সেটিকে ছত্রাকমুক্ত রাখার ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়। তারপর খুব কম খরচে হাতেই এসব পণ্য তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে বিষয়টি প্রথম হলেও যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও কেনিয়াতে কচুরিপানা দিয়ে সোফা, বেড, ওয়্যারড্রবও তৈরি হচ্ছে। সুদৃশ্য এসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে সারাবিশ্বেই।’

সম্ভাবনাময় কাগজ শিল্প

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিসরে নলখাগড়া থেকে যেমন প্যাপিরাস বা কাগজ প্রস্তুত হতো, তেমনি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কচুরিপানা থেকে এক ধরনের কাগজ উৎপাদন বহু আগেই শুরু হয়েছে। হাতে তৈরি এসব কাগজ দিয়ে লেখা ও কম্পিউটার প্রিন্ট ছাড়াও নোটবুক, ব্যাগ, অ্যালবাম, ফটো ফ্রেম, নিমন্ত্রণ কার্ড, কাগজের গয়না, ফাইল তৈরি হয়। 

আগৈলঝাড়ার বিবর্তনের উৎপাদিত হাতে তৈরি কাগজ ও পণ্যর সবচেয়ে বেশি চাহিদা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জাপান, হংকং, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভারতে। বাংলাদেশেও এর চাহিদা বাড়ছে। 

স্যানিটারি ন্যাপকিনে নারীর স্বাধীনতা

সম্প্রতি কচুরিপানা থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী নাজিবা নায়লা ওয়াফা এটি নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প চালান। তিনি অবশ্য আইডিয়া নিয়েছেন কেনিয়ার ‘জানিপ্যাড’ নামক একটি কোম্পানি থেকে। 

ওয়াফা জানান, কচুরিপানা শুকিয়ে, ব্লেন্ডারে গুঁড়া করে মাঝে ও ওপরে তুলা দিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো প্যাড তিনিসহ তার দলের আরো দুই নারী ব্যবহার করেন। ব্যবহারের দুই সপ্তাহের মধ্যে প্যাড মাটির সঙ্গে মিশে যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //