সড়ক যেন মৃত্যুপুরি!

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোনো মতেই একে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নতুন আইন হয়েছে। গণমাধ্যম থেকে রাজপথ- প্রতিবাদ হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে, তারপরও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর! 

যাত্রী কল্যাণ সমিতি চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের সড়ক দুর্ঘটনার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৫৩১টি ও মৃত্যু হয়েছে ৫৪৭ জনের। ফেব্রুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৫০৪টি ও মৃত্যু হয়েছে ৫৩৪ জনের। 

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্চের প্রথম আটদিনেই সড়ক দুর্ঘনায় প্রাণ হারানোর সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়েছে।

পরিবেশবাদী আইনজীবীদের সংগঠন ‘বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ যতই নড়েচড়ে বসি না কেন, এই দুর্ঘটনা কমাতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার সড়ক নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন তৈরি করেছে; কিন্তু পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের ধর্মঘটের কারণে এই আইন অনেকটা আটকে রয়েছে। নতুন আইনে জরিমানা ও সাজার পরিমাণ বেশি। তারপরও দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। কোনো প্রতিষ্ঠানের হুমকি-ধমকিতে সরকার যদি নতুন আইন শিথিল করে দেয়, তাহলে চালকরা আরো বেপরোয়া হয়ে পড়বে।’

চালকদের কর্মঘণ্টা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের চালকদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা নেই, এটি খুব জরুরি একটি বিষয়। তারা ট্রিপের ওপর নির্ভরশীল। আর এ কারণেই ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতাটা বেশি হচ্ছে। আইনের পাশাপাশি যদি দুর্ঘটনা কমাতে চান, তাহলে এই বিষয়টার ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।’

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনাও এক ধরনের খুন। এই খুনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান নতুন আইনে থাকলেও তা শিথিল করে দেয়ার কারণে যানবাহন চালকরা বেপরোয়া। কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর হলে চালকদের বেপরোয়া আচরণ অনেকাংশে কমবে। আবার অপরাধ করার পরও সংশ্লিষ্ট চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিআরটিএ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এই দুই সংস্থার উদাসীনতার কারণে বেশিরভাগ চালক কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেন না। সর্বোপরি কখনো কখনো পথচারীরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা ইচ্ছামতো সড়কের যেকোনো স্থান দিয়ে রাস্তা পারাপার হন। এতেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে চালকদের দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও মালিকরা গাড়ি চালাতে দেন। এটাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’

তিনি আরো বলেন, ‘সূক্ষ্ম ও ছোটখাটো অনেক ব্যাপারই বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের পুরনো যন্ত্রাংশ ঠিকমতো কাজ না করায় সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই চালকের উচিত তার গাড়ি সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা রাখা। গাড়িকে নিয়মিত চেকআপ করালে এ সংক্রান্ত দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া ছোট ছোট যান্ত্রিক ত্রুটি গুরুত্ব সহকারে আমলে নেয়া উচিত। কারণ ছোট একটি যান্ত্রিক ত্রুটি গাড়িতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারে।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তিনমাস অন্তর সড়ক দুর্ঘটনার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমে। নিরাপদ সড়ক চাই, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গত তিন বছরের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ সালে চার হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোট পাঁচ হাজার ২২৭ জন। আর আহত হয়েছেন ছয় হাজার ৯৫৩ জন। ২০১৮ সালে তিন হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় চার হাজার ৪৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আর এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন সাত হাজার ৪২৫ জন।  

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয় না। ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজা হয় মাত্র এক শতাংশ। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের খুব বেশি চাওয়া নেই। আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই। আর সড়কে অনাকাক্ষিত মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হলে কঠোর আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন। কেন ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে মামলা হয় না? সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। আর যে ২০ শতাংশ মামলা হয়, সে ক্ষেত্রে কেন এক শতাংশের সাজা হয়? সেই বিষয়গুলো নিশ্চয়ই রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘চালক যদি দোষী হয়ে থাকে, কেন তার সাজা হয় না। মালিকদের যদি কোনো গাফিলতি থেকে থাকে, তাদেরও আইনের আওতায় আনলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের চাওয়া সড়কে যেন অকালে আর একটি প্রাণও না ঝরে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘গত কয়েক মাসে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। হাইওয়ে ও শহরের মধ্যে দুর্ঘটনার ধরন-কারণ ভিন্ন। শহরের দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রথমেই বলতে হবে গণপরিবহনের কর্মীদের দায়িত্বহীনতার কথা। গণপরিবহনের যে মান থাকার কথা, তা নেই। যখন গণপরিবহন কর্পোরেট কালচার নিয়ে এগোবে, চালক ও বাস মানসম্পন্ন হবে, বাস চলাচলের জন্য স্পেশাল লেন থাকবে, তখন এ ধরনের দুর্ঘটনা হয় না। অথচ আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ নেই, মুনাফা বাড়ানোর জন্য চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালায়, ১৬ ঘণ্টা টানা বাস চালাচ্ছে, বেতন কাঠামোর ঠিক নেই। এরকম একটি বড় সিটিতে এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা চালানো হলে দুর্ঘটনা ঠেকানো যাবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকার মতো আয়তনের দ্বিতীয় কোনো সিটি খুঁজে পাবেন না, যেখানে ৫০ কোম্পানি মুনাফার দিকে নজর দিয়ে পরিবহন চালাচ্ছে। পরিকল্পিত বাস অপারেশনের অনুপস্থিতির কারণেই ঢাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে।’

সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে উল্লেখ করে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। দৈনিক চুক্তিভিক্তিক ইজারায় মালিকরা তাদের বাস চালকের হাতে তুলে দেন। এ কারণেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য সড়কে ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ ধরনের ব্যবস্থা আর কোনো দেশে নেই। এই অরাজকতা বন্ধ করা না গেলে নগরে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।’

দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ইলিয়াস কাঞ্চন দেখছেন কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারির অভাব। 

তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে দেশের সড়কে যানবাহন বেড়েছে ১০ লাখেরও বেশি, কিন্তু সেই অনুপাতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি না বাড়ার কারণে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। অনেক নির্দেশনা, আইনই মানা হয় না ও সেগুলো নজরদারির আওতায়ও থাকে না। মূল শহরের রাস্তায় বা মহাসড়কে কম গতির যানবাহনগুলো না চলার বিষয়ে যে নির্দেশনা ছিল, তা অনেকাংশেই মানা হয় না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘এখন অনেক হাইওয়েতে চার লেন করা হয়েছে। চার লেন হওয়ার পর রাস্তায় যানবাহনের গতি বেড়েছে, কিন্তু একইসাথে রাস্তায় কম গতির যানবাহন চলাচল করতে দেয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। আর এই কম গতির যানবাহনের চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মানুষের মৃত্যু বন্ধে কোনো চেষ্টা চলছে না, মানুষ মারার খেলা চলছে। নতুন আইন হয়েছে; কিন্তু এর প্রয়োগ হচ্ছে না। ফিটনেসহীন বিভিন্ন গতির যানবাহন একই রাস্তায় চলছে, যথাযথভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্সও দেয়া হচ্ছে না। তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে কীভাবে? নতুন সড়ক পরিবহন আইন হওয়ার পর বড় গাড়ির চালক-মালিকেরা দাবি করেছেন, তাদের জুন পর্যন্ত ছাড় দিতে হবে। জুনের পর আবার রাস্তায় যখন ম্যাজিস্ট্রেটরা নামবেন, তখন বলা হবে, আরো ছয় মাস থেকে এক বছরের সময় দেন, আমরা এর মধ্যে করে নেব। এই তো চলছে। প্রতিদিন রক্তাক্ত হবে রাজপথ। কারণ এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই, কেবল নৈরাজ্য।’

তিনি বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের কেউ না কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা সব দলে আছে, তারা প্রভাবশালী। তারা কোনো আইন করতে দেয় না। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে শৃঙ্খলায় আসা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু হলে ধর্মঘট করে তারা সারাদেশ অচল করে দেয়। ফলে এখানে কোনো কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বার্থের কাছে এসে সব দল এক হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মারার খেলা চলছে সড়কে।’ 

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে ফিটনেস নবায়ন হয় শুধু কাগজের। গাড়ি ঠিক আছে কি না, যন্ত্রাংশ ঠিক আছে কি না, রাস্তায় চলার উপযোগী আছে কি না, সেই পরীক্ষা হয় না; কিন্তু সারা পৃথিবীতে গাড়ি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়। এ সময় দেখা হয়, গাড়িতে কোনো সমস্যা আছে কি না, সমস্যা থাকলে সেগুলো ঠিক করার পর ফিটনেস সনদ দেয়া হয়। এছাড়া যে প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স দেয়া হয়, সেটিও ঠিক নেই আমাদের দেশে ১৮-২২ বছরের ছেলেরা বাস-ট্রাক চালাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব!’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //