কভিড-১৯ মহামারির মাঝেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব

ডেঙ্গু আজকের নতুন বাস্তবতা নয়। চলমান কভিড-১৯ মহামারির মাঝেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। 

২০১৯ সালের সরকারি হিসেবেই এক লাখেরও চেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে তখন। 

দরিদ্র এ দেশের মানুষের পক্ষে একসাথে দুটি প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কি আছে? যে কেউ বলবে, বাংলাদেশের সে সক্ষমতা নেই। তাই প্রতিরোধ জোরদার করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

দৃশ্যমান শত্রু ডেঙ্গু। আমরা জানি, মশা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় না। এডিস জাতীয় মশার মাধ্যমে আমরা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হই। একটু চেষ্টা করলেই ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার মতো দৃশ্যমান শত্রুটাকে মোকাবেলা করা সম্ভব; কিন্তু একেবারেই নতুন ধরনের করোনাভাইরাস মোকাবেলা করা ভীষণ কঠিন। যেখানে ব্রিটেন, আমেরিকা অথবা ইতালির মতো উন্নত দেশও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না! 

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। শুরুর দিকে করোনাভাইরাস কিছু নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে কমিউনিটি লেভেলে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সীমিত পর্যায়ে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। 

বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ও জেলায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এই ভাইরাসটিতে। এর মধ্যেই রাজধানীর মিরপুর ও বাসাবোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, গাইবান্ধা ও কক্সবাজারেও আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। 

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০ শতাংশ কভিড-১৯ রোগী কার মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছেন, তা ‘ট্রেস’ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

করোনা ও ডেঙ্গু বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মরার উপর খাড়ার ঘা। অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাস কোথায় আছে, কার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে এটা হয়তো দেখা যায় না, বলাও যায় না। কিন্তু ডেঙ্গু তো মশার মাধ্যমে ছড়ায়। নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটিয়ে দিলেই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। গত বছর মশার ওষুধ নিয়ে যা ঘটেছে, এবার তা হতে দিলে বাংলাদেশে শুরু হয়ে যাবে বিশাল মানবিক বিপর্যয়। দেখা যাবে, মানুষ একইসাথে ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাস দুটিতেই আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। তখন হয়তো মানুষকে বাঁচানোও কঠিন হয়ে যেতে পারে। সে কারণে আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই- দেশবাসীর স্বার্থেই কার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলুন। নয়তো দুইটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব একসাথে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।’  

চলতি বছরের শুরু থেকে গত ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি হিসেবেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৭৪ জন। আশার কথা হলো- গত তিন মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। মার্চে আক্রান্ত হন ২৭ জন; এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ ও জানুয়ারিতে ১৯৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর বেশির ভাগই রাজধানীতে ঘটেছে। এটা সরকারি হিসেব। নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়ে থাকেন তাদের হিসেবটাই সরকারিভাবে দেয়া হয়। 

এর বাইরে অনেক ছোট ছোট হাসপাতাল, চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে চিকিৎসা করান লোকজন। যে হিসেবটা সরকারি দফতরে কখনোই যায় না। ফলে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে ঠিক কত মানুষ আক্রান্ত হন অথবা মারা যান; এর সঠিক হিসেব কখনোই পাওয়া যায় না। 

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘বৃষ্টির সাথে ডেঙ্গুর বংশ বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে, এটি এখন সবাই জানে। মার্চে বৃষ্টি কম হয়েছে বলে মশাও কম ছিল। সামনে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেলেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে। কাজেই মশা মেরে ফেলতে হবে। অগ্রাধিকার দিয়েই সিটি করপোরেশনের উচিত ওষুধ দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা।’

২০১৯ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা মারতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। মশা মারার ওষুধ নিয়ে ঘটে যায় তুঘলকি কাণ্ড। টেন্ডার নিয়ে সরবরাহ করা হয় মেয়াদোত্তীর্ণ-ভেজাল ওষুধ। সিটি করপোরেশনের ওই ওষুধে মশা মরেনি। ফলে এক লাখ মানুষকে ভুগতে হয় ডেঙ্গু জ্বরে। এর বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা।

চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মশা মারার ওপর গুরুত্ব দিলেও বাস্তবে সেই নিদের্শের প্রতিফলন খুব কমই দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় ওষুধ ছিটালেও অনেক এলাকায় যেন চলছে মশার রাজত্ব। মশার জন্য মানুষ রাতের বেলায় তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও কাজ করতে পারে না। 

বিশেষ করে এটা ঘটছে সেসব জায়গায়, যেখানে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ বাস করে। যেমন- রাজধানী মুগদা, বাসাবো, কদমতলা, গোড়ান, সিপাহীবাগ, মেরাদিয়া, পূর্ব বাড্ডার মতো স্থানের নিচু এলাকায়, যেখানে নালা ও কিছু ঝোপ-জঙ্গল রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //