কভিড-১৯ মোকাবেলা

সরকারি ঘোষণার বাস্তবায়নে ঢিলেমি

করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) চিকিৎসা সংক্রান্ত সরকারের ঘোষণা থাকলেও যথাযথ বাস্তবায়ন একেবারেই কম। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলন করে কভিড-১৯ সংক্রান্ত যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার অনেকটাই এখন কথার কথায় পরিণত হয়েছে। 

এ ব্যাপারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা দেখা যাচ্ছে। 

তিনি বলেন, ‘আসলে পরিস্থিতিটা ক্লোজলি বোঝার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়ে গেছে মনে হয়। মনে হচ্ছে যেন চিন্তা-ভাবনা না করেই একেক সময় একেক ধরনের ভাবনা আসছে। কিংবা অনেক সময় অনেক জায়গা থেকে হয়তো চাপও আসে। সে কারণেও কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্তহীনতাটা দেখা যায়।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সাথে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের কোনো যোগসূত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে না এবং সেখানে সম্ভবত একটা ফারাক রয়ে গেছে।’ 

কভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রথম সারির যোদ্ধা হলেন চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রমে ব্যস্ত তারা। ওই যোদ্ধাদের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটুকু, তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। 

করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য যেসব হাসপাতালের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলোই বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। কভিড-১৯ হাসপাতাল হিসেবে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করছে কেবল কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। মাত্র কয়েকদিন আগে মুগদা জেনারেল হাসপাতালকেও যোগ করা হয়েছে এর চিকিৎসায়। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটকেও কভিড চিকিৎসার হাসপাতাল হিসেবে পরিণত করার কথা; অথচ এর বাস্তবায়ন নেই। শেরেবাংলা নগরের সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মহানগর জেনারেল হাসপাতালকেও কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য ঘোষণা দেয়া হয়, যার বাস্তবায়ন নেই।

ভাইরাসটি সমাজে ছড়িয়ে পড়ার কারণে এখন রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যত বেশি পরীক্ষা করা হবে, ততই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। এদিকে, আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার হার একেবারেই কম বাংলাদেশে। রাজধানীতে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ফলে এখানেই চিকিৎসা ও হাসপাতালের ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা; অথচ তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

উল্লেখ্য এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি। গত ৮ মার্চ প্রথম তিনজন আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ১ মে  পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন মাত্র ১৭৪ জন। এ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭০ জন। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সুস্থতার চেয়ে মৃত্যুর হার বেশি। সুস্থতার হার কম বলে রোগীদের চিকিৎসাধীন থাকতে হচ্ছে অনেক বেশি দিন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ মাত্রাটা এখনো আসেনি। ফলে আক্রান্তের সংখ্যাটা বাড়ছে। তবে কবে শেষ হচ্ছে, এটা বলার সময় এখনো আসেনি। এ কারণে আরো বেশিসংখ্যক হাসপাতালের প্রয়োজন হবে ঢাকাসহ সারাদেশেই।’ 

সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালে রাজধানীর এই তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অনেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তবে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, মে মাসে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ এবং মৃত্যুবরণ করতে পারে ৮০০ থেকে এক হাজার। অথচ চিকিৎসার জন্য সারাদেশে হাসপাতালে মাত্র ছয় হাজার বেড রয়েছে।

সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এ ভাইরাসটি এই প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে প্রথম চীনে এর প্রাদুর্ভাবের পর ভাইরাসটি এর ভেতরের গঠনগত পরিবর্তন এনেছে বহুবার। ফলে এর কোনো ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। তাও তা আগামী সেপ্টেম্বরের আগে সবার ব্যবহারের জন্য আসবে না। তাই ভীতিকর এ ভাইরাসটির চিকিৎসায় ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী অত্যাবশ্যক। অথচ তা সরবরাহে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে অবহেলা। ডাক্তার-নার্সদের যে ধরনের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সরবরাহ করা হচ্ছে, এর মান প্রশ্ন সাপেক্ষ। আগে থেকেই এখানকার ডাক্তাররা বলে আসছেন যে সরবরাহ করা পিপিই যথাযথ পরীক্ষিত নয়, এগুলো নিম্নমানের। 

স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা পিপিই যে ‘মানসম্পন্ন না’, তা নিয়ে সমালোচনার সঙ্গে যোগ হয়েছে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের কথাও। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় ও বিতরণ বিভাগের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সিএমএসডি থেকে সরবরাহ করা মাস্কগুলো এন-৯৫ ছিল না। পরে আবার তিনি আরেকটি প্রেস বুলেটিনে বলেন, সিএমএসডির কাছে এন-৯৫ সমমানের মাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে।

এন-৯৫ মাস্ক হলো বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহৃত মাস্ক, যা মুখে পরিধান করলে বাইরের বাতাস নাক দিয়ে যাবে মাত্র ৫ শতাংশ। আরো সহজ করে বলতে গেলে, পরিবেশে কোনো জীবাণু থাকলে এন-৯৫ মাস্ক ৯৫ শতাংশ জীবাণু বা বস্তু কণা প্রতিরোধ করবে। করোনাভাইরাসের চিকিৎসার সাথে জড়িত ডাক্তার ও নার্সদের থাকার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা প্রয়োজন। পরিবারের সাথে তাদের থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশ্বব্যাপী তাদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের থাকার জন্য আলাদা আবাসনের ঘোষণা দিলেও এর বাস্তবায়ন নেই। রাজধানীতে কয়েকটি হোটেলকে ঠিক করা হয়েছিল ডাক্তার ও নার্সদের আবাসনের জন্য; কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। 

জানা গেছে, হোটেল কর্তৃপক্ষ ডাক্তার ও নার্সদের আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য রাজি থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে আর যোগাযোগ করা হয়নি। আবাসনের জন্য হোটেলের যে বিল হবে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বাজেটে তা নেই। নতুন করে আবাসনের ব্যবস্থা তারা করতে পারছে না। ফলে ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছেই। 

করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য উন্নতমানের খাবারের প্রয়োজন। অথচ হাসপাতালগুলোতে তারা কার্যত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নার্সরা শুধু ডাল ও আলু ভর্তা খেয়ে দিন কাটিয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর মাধ্যমে দেশবাসী অবগত হয়েছেন। খাবার সরবরাহে ব্যর্থতার কথা শুনে শেষ পর্যন্ত বেসরকারিভাবে কেউ কেউ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নার্সদের খাবার সরবরাহ করেছেন বলে জানা যায়। অথচ এর সবই স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //