গণপরিবহনে স্বাস্থবিধি মানা নিয়ে অভিযোগ ও শঙ্কা

দুই সপ্তাহের জন্য ‘সীমিত পরিসরে’ গণপরিবহন চালু হবার তিনদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগ ও আশংকা প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। 

গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো বলে মন্তব্য করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত ৭২ ঘন্টার পরিসংখ্যান বলছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। অফিস আদালতে, গণপরিবহনে স্বাস্থ্য বিধি মানা হলেও ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। 

তাই যারা বিভিন্ন কাজে বের হচ্ছেন তাদেরকে গণপরিবহন এড়িয়ে চলার তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রক্রিয়ার মধ্যেই আশংকা থেকে যাচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞদের কথার সূত্র ধরে কয়েকজন যাত্রীর সাথে কথা বলেও জানা গেছে সেই একই আশংকার কথা। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, মে মাসের ২ তারিখ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৭৯০ জন। কিন্তু ঠিক এক মাস পরে ২ জুন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে  ৫২ হাজার ৪৪৫ জন।

একমাস আগে মৃতের সংখ্যা ছিলো ১৭৭ জন এবং ২ জুন পর্যন্ত ৭০৯ জন রোগী মারা গেছেন। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, টেস্টের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যানও বেড়ে গেছে। তারা এটাও বলছেন, জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সরকার স্বাস্থ্যবিধি ঠিক করে দিলেও শেষ রক্ষা হবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে খুব তাড়াতাড়ি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। এখন নিজের সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। গণপরিবহন চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সেক্টরেই ভাইরাসটি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ এটি পরিবহন মালিক-শ্রমিক-যাত্রী বোঝে না। আক্রান্ত কারও হাঁচি বা কাশিতে থাকা জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ লেগেছে এমন কোনো বস্তু স্পর্শের মাধ্যমেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির দুই মিটারের মধ্যে থাকা অন্য ব্যক্তিকেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। অফিসে কিছুটা স্বাস্থ্যবিধি মানা গেলেও গণপরিবহনে এটা সম্ভব না। এখন এখানেও মানা হচ্ছে তারপরও শঙ্কা থেকে যায়। এটি কতদিন মানবে তারা। অতীতে গণপরিবহনের যে বেপোরোয়া আচরণ দেখেছি। তাই শঙ্কার জায়গা। আমি যাত্রীদেরকে  পরামর্শ দেবো কষ্ট করে হলেও গণপরিবহন এড়িয়ে চলার জন্য।  

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফয়জুল হাকিম একটি পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় দেখলাম প্রথম দিনে ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত থাকলেও  লঞ্চে তা ছিল না। পটুয়াখালী থেকে ঢাকাগামী একটি লঞ্চকে অতিরিক্ত যাত্রীবহনের দায়ে জরিমানা করেছিলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রতিবাদে লঞ্চ মালিকরা মিলে পটুয়াখালী থেকে ঢাকামুখী লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। ৮০ থেকে কমে ৬০ শতাংশের বাস ভাড়া কমার ফলে বাসের অবস্থা যে কী হবে তা আলোচনায় আনতে গেলে কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। 

তিনি আরো বলেন, গত তিনদিনে মৃতের সংখ্যা একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো, আক্রান্তের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যতই সীমিত বলা হোক না কেন সীমিত রাখা যাচ্ছে মানুষের চলাচল। রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান, বাজার সবখানেই মানুষের ভীড়। এই ভীড় সপ্তাহ খানেক পড়েও দেখা যাবে গণপরিবহণগুলোতে। 

তারা আরো বলছেন, একদিকে সচেতনতার অভাব, অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য উপকরণও সহজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

করোনাভাইরাস শনাক্তে রাজধানীসহ সারাদেশের সর্বমোট ৫২টি আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে গতকাল মঙ্গলবার (২ জুন) এ যাবতকালের সর্বোচ্চ রেকর্ডসংখ্যক ১৪ হাজার ৯৫০টি নমুনা সংগ্রহ এবং ১২ হাজার ৭০৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক ২ হাজার ৯১১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। 

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। আজ পর্যন্ত দেশে মোট ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করে সর্বমোট ৫২ হাজার ৪৪৫ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।

গতকাল দুপুর ৩টায় সরেজমিনে সদরঘাট বাস টার্মিনালে দেখা গেছে, বাসে ওঠার সময় যাত্রীদের হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দুই আসনে একজন করে যাত্রী বসছেন। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হচ্ছে না। কিন্তু আশংকার জায়গা হচ্ছে যাত্রীরা যখন বাসে উঠছেন তখন গায়ে গা ঘেঁষে উঠছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হেলপারের শরীরে স্পর্শ লাগছে কোনো কোনো যাত্রীর। বাসের হেলপার, কন্ডাক্টারও ঠিকমতো মাস্ক ব্যবহার করছেন না। অনেক হেলপারকে নাক বের করে শুধু মুখের ওপরে মাস্ক পরতে দেখা গেছে। বাসের অনেক আসন অপরিচ্ছন্ন ছিলো সেগুলো দেখলেই মনে হবে জীবাণুমুক্ত করা হয়নি। 

সাভার পরিবহনের কয়েকজন যাত্রীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা আশংকামুক্ত থাকছেন না। কতদিন এই স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তার। 

সদরঘাট থেকে ভিক্টোর ক্লাসিক বাসের হেলপার বলেছেন, যাত্রীরা ওঠার সময় হাতে শুধু স্প্রে মেরেছি। বাসের মধ্যে আর কোনো সরঞ্জামাদিও নেই। 

প্রায় দ্ইু ঘন্টা পল্টন ও জাতীয় প্রেসক্লাব সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকারের কোনা সংস্থার অভিযান বাসগুলোতে করতে দেখা যায়নি। 

এদিকে গণপরিবহন চালুর প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত সারাদেশ জুড়ে স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগ এসেছে। কোথাও কোথাও গণপরিবহণ মালিককে জরিমানাও করা হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে মতবিনিময়ে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। 

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, দেশের কিছু কিছু জায়গাতে স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগ এসেছে। এক্ষেত্রে শুধু বাস স্টাফদের অভিযোগ করার সাথে সাথে যাত্রীদেরকেও সচেতন হতে হবে। তারাও বাসে ওঠার সময় তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে বাসে ওঠছেন না। আশা রাখি সচেতনতার মাধ্যমেই আমরা এই ভাইরাস থেকে মুক্ত হতে পারবো। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //