প্রস্তুতিবিহীন লকডাউনে সাফল্য সুদূর পরাহত

কৌশলগত প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত না করে লকডাউন দেয়াটা হবে আবারো ভুল সিদ্ধান্ত। এতে করে প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঠিক এভাবেই সাবধান করেছিলেন সরকারকে; কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ খুবই কমই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। লকডাউন তুলে দিয়ে মানুষকে অবাধে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। পুরো দেশে অঘোষিত লকডাউন দিলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ না করায় মানুষ এই সুযোগে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়িয়েছে। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায়- শনাক্তের বাইরেও অসংখ্য মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন।

এরই মধ্যে সরকার আবারো লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে; কিন্তু এবার পুরো দেশে নয়, অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন হবে। সবুজ, হলুদ ও লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের লকডাউন ভালো, তবে এর সুফল নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। বাস্তবায়নের সরকারি তৎপরতা যত জোরদার হবে লকডাউন তত ফলপ্রসূ হবে। তবে লকডাউনের আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা তেমন আশাপ্রদ নয়। 

গত ২৬ মার্চ থেকে অঘোষিত লকডাউন শুরু হলেও, এটি দেশের মানুষ যেমন যথাযথভাবে পালন করেনি, তেমনি প্রশাসনও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য পুলিশের সাথে সেনাবাহিনীকেও নামানো হয়েছিল; কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের মানে হলো- মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত না করে দেশের অর্থনীতি যেন দুর্বল হয়ে না পড়ে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। যেখানে কভিড-১৯ রোগী নেই বা কম, সেখানে সব কাজ-কর্ম স্বাভাবিকভাবে চলতে দেয়ার জন্য অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন দেয়া হয়।

সরকারিভাবে বলা হয়েছে, লাল এলাকায় মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা থাকবে। লাল ও হলুদ এলাকায় শপিংমল বন্ধ থাকবে; তবে সবুজ এলাকায় খোলা থাকবে। হলুদ ও সবুজ এলাকায় মুদি দোকান খোলা থাকবে, যা লাল এলাকায় বন্ধ থাকবে। লাল এলাকায় গণপরিবহন চলাচল করবে না, এমনকি এই এলাকায় স্টপেজও থাকবে না। কেবল রাতে মালবাহী যান চলাচল করতে পারবে। হলুদ এলাকায় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলতে পারবে। একজন করে যাত্রী নিয়ে রিকশা ও অটোরিকশা চলতে পারবে। এই এলাকায় মালবাহী যানও চলবে। আর সবুজ এলাকায় স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চলতে পারবে। লাল এলাকার মসজিদে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ; হলুদ ও সবুজ এলাকায় দূরত্ব বজায় রেখে যাওয়া যাবে। লাল ও হলুদ এলাকার মানুষের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করার জন্য ভৌগোলিক বাস্তবতা অনুসরণ করে সড়ক ও গলির মুখ বন্ধ করা হবে। এছাড়া মহল্লার ভেতরে আড্ডাও বন্ধ থাকবে। লাল ও হলুদ এলাকায় কাঁচাবাজারের জন্য নির্ধারিত ভ্যান সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হবে। আর লকডাউন এলাকায় বস্তি থাকলে দুই সপ্তাহের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা রয়েছে গাইডলাইনে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মেজাহেরুল হক বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা বিজ্ঞানভিত্তিক। এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া উচিত হবে না। সেই সাথে লাল অঞ্চলকে পরীক্ষার আওতায় না আনলে আমরা বুঝতে পারব না, সেই এলাকায় সংক্রমণ কমছে কিনা।’

অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের আগে সরকার চিন্তা করেছিল হার্ড ইমিউনিটির (গণরোগ প্রতিরোধ) দিকে যেতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে কারণেই সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা না নিয়েই লকডাউন তুলে নিয়েছে। তাহলে হার্ড ইমিউনিটিটা কি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে সে প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হার্ড ইমিউনিটি বা গণ রোগ প্রতিরোধ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই হার্ড ইমিউনিটি মোটেও সহজ নয়। 

গবেষকদের মতে, কোনো নির্দিষ্ট রোগ বা সংক্রমণ ছড়ানোর পর কোনো জনগোষ্ঠীর অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে যদি এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়, তাহলে বাকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের মাঝে আর সেটি ছড়াতে পারে না। অতীতে ১৯৮০ সালের মধ্যে এভাবেই টিকা দিয়ে নির্মূল করা হয়েছিল গুটি বসন্ত। 

মূলত দুটি উপায়ে কোনো রোগের বিরুদ্ধে এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারে মানুষ। এর একটি হলো- মানুষের শরীরে ওই রোগের টিকা বা প্রতিষেধক প্রয়োগ করা। করোনাভাইরাসের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। আর অন্যটি হলো- দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষকে আক্রান্ত করে সুস্থ করে তোলা। 

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের এ পদ্ধতিতে হয়তো করোনাভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব; কিন্তু বাংলাদেশ যদি এই পথে হাঁটে, তাহলে এর বড় মূল্য দিতে হতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষকে আক্রান্ত হতে দিলে কম করে হলেও দেশের ৯ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে এবং এতে করে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৮ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। দেশবাসী কি এই মৃত্যু মেনে নিতে রাজি হবে? ধরি, ৯ কোটি মানুষ তিন বছর ধরে নয়, এক বছর ধরেও আক্রান্ত হয় তাহলে প্রত্যেক মাসে তিন থেকে চার লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এর মধ্যে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার মানুষের ভেন্টিলেটর সাপোর্ট লাগবে। বর্তমান বাংলাদেশে কি এর সুযোগ আছে? 

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ইমিউনিটি ছয় মাস পর্যন্ত থাকে। ছয় মাস পর পর ১৮ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। আমরা কি এত মানুষ মরে যেতে দিতে রাজি আছি?

করোনাভাইরাসে নিউজিল্যান্ডের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা যায়। দেশটি অত্যন্ত সফলতার সাথে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। সেখানে এখন একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষও নেই। গত ৮ জুন সংক্রমণ শুরুর ১০১ দিনের মাথায় পুরোপুরি করোনাভাইরাস মুক্ত ঘোষণা দিয়েছে নিউজিল্যান্ড। দেশটিতে আর একজনও কভিড-১৯ রোগী নেই বলে জানিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক অ্যাশলে ব্লুমফিল্ড। 

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রথমবার একজনও আক্রান্ত না থাকা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক বড় মাইলফলক। তবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান সতর্কতা অব্যাহত থাকবে।’

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিরাট সাফল্য দেখিয়ে বিশ্ববাসীর প্রশংসায় ভাসছে নিউজিল্যান্ড। প্রায় ৪৯ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে মাত্র এক হাজার ১৫৪ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ২২ জন। মহামারি নিয়ন্ত্রণে দেশটি কড়া লকডাউনে ছিল টানা ৭ সপ্তাহ। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত মাসে তুলে নেয়া হয় বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা। 

এর আগে, গত ২৭ মে নিউজিল্যান্ডের হাসপাতাল থেকে শেষ করোনাভাইরাস রোগীকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এরপর ১২ দিনে নতুন করে কেউ আক্রান্ত হয়নি দেশটিতে। ফলে প্রথম রোগী শনাক্তের সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই পুরোপুরি করোনাভাইরাস মুক্ত হলো নিউজিল্যান্ড। চীনকে বাদ দিলে এর আগে ভিয়েতনাম করোনাভাইরাস মুক্ত ঘোষণা দিয়েছে। 

সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে যে অঘোষিত লকডাউন দিয়েছিল, তা কাজে লাগিয়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি, যা অন্য দেশ পেরেছে। প্রশাসন থেকে ইতিবাচক প্রচেষ্টার যথেষ্ট অভাব ছিল। আবার জনগণের মধ্যে লকডাউনকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, আমাদের দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //