করোনাভাইরাস

বাড়ছে ভিআইপিদের আক্রান্ত ও মৃত্যু

করোনাভাইরাসে দেশে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আক্রান্তের সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ভয়াল এই থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না সরকারের এমপি, মন্ত্রী, ভিআইপিরাও। ভিআইপিদের মৃতের তালিকাটি প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। এভাবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবরে অনেকটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসন, সরকার ও সাধারণ জনগণের মাঝে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স্ক আর ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগে যারা ভুগছিলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। আমাদের দেশে যেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তারা সবাই করোনাভাইরাস উপসর্গ ছাড়াও অন্যান্য রোগে ভুগছিলেন। অধিকাংশরই বয়স ষাটোর্ধ্ব।

১৫ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মারা গেছেন। গত ১৩ জুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার মরদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। তার আগের দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। 

আশার কথা হলো- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন। তিনি ফোনে জানান, ‘এখন ভালো অনুভব করছি। এই লড়াইয়ে আমাদের সবাইকে জয়ী হতে হবে।’

নওগাঁ-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহিদুজ্জামান সরকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর নিজের ফ্ল্যাটে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে এখন স্বাভাবিক কাজকর্ম করছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরবন্দি থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা না হলে ঘরে বসেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।’ করোনাভাইরাসের সঙ্গে এখনো লড়াই করতে হচ্ছে বিকন ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবাদুল করিম বুলবুলকে। 

বিশিষ্টজনের মৃত্যুর তালিকা

করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের শুরুতে গত ৬ এপ্রিল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান মারা যান। সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দীন গত ১৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। করোনাভাইরাসে মৃত দেশের প্রথম ডাক্তার তিনি। 

দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খোকন গত ২৮ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃতের নমুনা সংগ্রহ করে কভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছিল। ২৯ এপ্রিল রিপোর্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।

দেশের অন্যতম হেমাটোলজিস্ট এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট অধ্যাপক কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান করোনাভাইরাসের শিকার হয়ে গত ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো দেশের দ্বিতীয় চিকিৎসক তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. নাজমুল করিম গত ৭ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির গত ১০ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 

দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান গত ১৪ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃতদেহ থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হলে জানা যায়, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। ২৪ মে মারা যান সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুর। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৬ মে না ফেরার দেশে পারি জমান এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনের রেফারি ও বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সদস্য হুমায়ুন কবীর জুয়েল। 

এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে গত ৩০ মে মারা যান শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাবেক সচিব এম বজলুল করিম চৌধুরী গত ৩১ মে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক, রাজউকের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার (পিআরএল) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত উপ-মহাপরিচালক, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির উপদেষ্টা (অনুষ্ঠান), এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ গত ১ জুন করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশের চা-শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী বিশিষ্ট শিল্পপতি আজমত মঈন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ জুন করোনাভাইরাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি মৌলভী চা-কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, সুরমা চা-কোম্পানির পরিচালক ছিলেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ৭ জুন রাজধানীর অভিজাত স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক (মেডিক্যাল সার্ভিস) ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট মির্জা নাজিম উদ্দিন মারা যান। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানও গত ৭ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। 

বিশিষ্টজনের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য বিষেশজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনাভাইরাস ভিআইপি, নন-ভিআইপি বোঝে না। তবে আমরা এই পর্যন্ত যেসব বিশিষ্টজনদের হারালাম তাদের মধ্যে ৯৭ ভাগেরই বয়স ষাট এবং সত্তরের ওপরে। তারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।’

আক্রান্ত ডজনখানেক মন্ত্রী-এমপি

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে ও হাসপাতালে ভর্তি আছেন আওয়ামী লীগের ডজন খানেক সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-এমপি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহার খাতুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়কমন্ত্রী বীর বাহাদুর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী লায়লা আরজুমান্দ বানুও হাসপাতালে ভর্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। আক্রান্তদের মধ্যে আরও রয়েছেন- নওগাঁ-২ আসনের শহীদুজ্জামান সরকার, যশোর-৪ আসনের রণজিৎ কুমার রায়, জামালপুর-২ আসনের ফরিদুল হক খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের এবাদুল করিম, চট্টগ্রাম-৮ আসনের মোসলেম উদ্দিন আহমেদ এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। নিজের ব্যক্তিগত সহকারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় বাসায় নিজেকে কোয়ারেন্টিনে রেখেছেন বলে ফোনে জানান বাগেরহাট-২ আসনের এমপি শেখ তন্ময়। 

রাজনীতিক ও ভিআইপিরা কেন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন- জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নিজেদের অসাবধানতার কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি। সরকারের মন্ত্রী-এমপি রাজনীতিকদের জনগণের পাশে বেশি থাকতে হচ্ছে। অফিস-আদালত খুলে দেয়ায় ঘরে বসে নেই কেউ। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। যে কারণে করোনাভাইরাসের শিকার হতে হচ্ছে তাদের।’

করোনাভাইরাসে বিএনপির ৬১ জনের মৃত্যু

বিএনপি নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গত ১৬ জুন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জানান, দলটির অন্তত ৬১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ জন বেড়ে হয়েছে ১৩৮ জন। এর আগে ১৩ জুন দুপুরে বিএনপির করোনাভাইরাস সেলের পক্ষ থেকে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫৬ নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ ও ১২১ নেতাকর্মী আক্রান্তের কথা জানিয়েছিলেন।

সরকারের ব্যর্থতায় দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল চলছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীন আচরণে দেশে কভিড-১৯ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে দেশে মৃত্যু হাজার ছাড়িয়েছে, আক্রান্ত প্রায় লাখের কাছে। বেসরকারি বা অন্যান্য সূত্রে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //