বাংলাদেশে করোনা সমাপ্তির পূর্বাভাস যে কারণে ব্যর্থ

সিঙ্গাপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সমাপ্তির সময় নিয়ে একটি প্রজেকশন দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সমাপ্তি নিয়ে একটি সময়চিত্র দেয়া হয়েছিল। তবে গবেষণাটিতে কিছু অসঙ্গতি থাকায় পূর্বাভাসটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকেই দাবি করেছিলেন, জুন মাস থেকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমবে, আর জুলাইয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

কিন্তু সব পূর্বাভাসই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার সাড়ে তিনমাস পরেও সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ নেই। পরিস্থিতি সামলাতে সরকার এখন ভিন্ন পদ্ধতিতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও কিছুদিন আগে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছিল।


ভুল পূর্বাভাসের কারণ

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ জানান, যে পরিস্থিতি মাথায় রেখে তিনি কিংবা অন্যরা সম্ভাব্য সময়চিত্র দিয়েছিলেন, পরে সে পরিস্থিতি থাকেনি। সরকারও সাধারণ ছুটি তুলে নিয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা প্রজেকশন বলি বা মডেলিং বলি, সেগুলোতে আমাদের কিছু পূর্বশর্ত বা অ্যাসাম্পশন থাকে। সেক্ষেত্রে সেই পূর্বশর্তগুলো যদি প্রতিপালিত না হয়, তাহলে কিন্তু সেটা ঘটবে না। আমাদের এখানে ভালো কোয়ারেন্টিন হয়নি, আইসোলেশন হয়নি, লকডাউনটাও ভালো হয়নি। ফলে সংক্রমণ কমার যে ধারণা, সেটাও বাস্তবে হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মো. রিদওয়ানুর রহমানও বলছেন, বাংলাদেশে এতদিনেও যে সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী। এমনকি সংক্রমণ কমানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

তিনি বলন, বাংলাদেশে টেস্ট ক্যাপাসিটি অনেক কম। কন্টাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন একরকম নেই। এখানে যে হোম আইসোলেশন হচ্ছে সেটা ইফেক্টিভ নয়। সুতরাং এখানে গ্রাফটা নিচের দিকে নামবে না। এটা যে উঠছে, উঠতেই থাকবে। সামজিক সংক্রমণ না কমলে পিক কিংবা ডাউনফল দেখার সুযোগ নেই।


বাংলাদেশে সংক্রমণ এক লাখ ছাড়ানোর পর পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রিদওয়ানুর রহমান মনে করছেন, বাংলাদেশ এখন অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণের দিকে যাচ্ছে। ফলে সংক্রমণের গ্রাফ হঠাৎ করে নেমে যাবার সম্ভাবনা নেই।বাংলাদেশে এখন কিন্তু শুধু সংক্রমণই দেখতে পাচ্ছি, রোগ দেখা যাচ্ছে না। আর যেসব রোগী চিহ্নিত হচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই কিন্তু চার-পাঁচজন করে রোগী রেখে হাসপাতালে এসেছে।

তিনি বলেন, কন্টাক্ট ট্রেসিং না হওয়ায় এই সংক্রমিত লোকগুলো ঠিকভাবে চিহ্নিত হচ্ছে না। তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আমরা এখন অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণের মধ্যে আছি। ফলে গ্রাফটা চট করে নামবে না। অনির্দিষ্টকাল ধরে হাই লেভেলে এটা চলতেই থাকবে যদি না ক্রাশ প্রোগ্রাম না নেয়া হয়।


সংক্রমণে নিম্নগতি কবে আসতে পারে?

সরকার এখন বিভিন্ন জেলায় রেডজোন ভিত্তিক লকডাউনের পথে হাঁটছে। রাজাবাজার, কক্সবাজার, গাজীপুরের পর আরো ১৫টি জেলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।এসব জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা লকডাউনের আওতায় থাকছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ মনে করেন, লকডাউন এবং টেস্টসহ অন্যান্য কার্যক্রম ঠিকভাবে চললে ৪২ দিনের মাথায় এর একটা সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যাবে। বাংলাদেশে রেডজোন মাত্র দশ শতাংশ এলাকায়। বাকি এলাকাগুলোতে সংক্রমণ মারাত্মক নয়। এখন সেটা সারা বাংলাদেশে এক হাজারটা এলাকা হতে পারে।

এখন এক হাজার জায়গায় আমরা যদি এক হাজারটা টিম একসঙ্গে টানা ১৪ দিন, ২৮ দিন এবং এভাবে ৪২ দিন কাজ করি, তাহলে আমরা কিন্তু অল্প জায়গা হলেও বড় একটা ইম্প্যাক্ট দেখতে পাবো। অর্থাৎ সংক্রমণটা কমে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে যারা নিজেরা টেস্ট করতে চাইছেন, মূলত তারাই টেস্টের আওতায় আসছেন। কোন এলাকায় সংক্রমণ কোন পর্যায়ে তা নির্ধারণে সরকার নিজ থেকে র‍্যানডম টেস্ট করছে না।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রিদওয়ানুর রহমান আবার রেডজোন প্রক্রিয়াতেই গলদ দেখছেন। এবং ছোট ছোট এলাকা ধরে লকডাউন কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না বলেই মনে করেন।

আমরা যে সংখ্যার উপর নির্ভর করে এলাকা নির্ধারণ বা জোনিং করছি, সেটা হচ্ছে হেলথ সিস্টেম ডাটা। এই হেলথ সিস্টেম ডাটা হচ্ছে প্যাসিভ ডাটা। অর্থাৎ মানুষ নিজেই ঠিক করেছে যে আমি টেস্ট করবো। আমাদের হেলথ সিস্টেম নিজে টেস্ট করে দেখতে যায়নি যে, মোহাম্মদপুরে কত পার্সেন্ট সংক্রমণ আছে, মিরপুরে কত আছে।

তিনি বলেন, এটা দেখে যদি জোনিং করা হতো তাহলে সেটা এপ্রোপিয়েট ডাটা ভিত্তিক হতো। এজন্য জোনিংয়ে এখন বড় এলাকা ধরে লকডাউন না করলে খুব একটা ফল আসবে না।


সরকারের ভাষ্য

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় রবিবার যে ১০টি জেলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে, সেখানে জেলাগুলোর কোন কোন এলাকা রেডজোনের আওতায় থাকবে সেটা উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সংক্রমণ যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, জোনভিত্তিক লকডাউনে এর রাশ টেনে ধরা যাবে। আমাদের এখানে যারা টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটিতে আছেন, যারা জনস্বাস্থ্যবিদ তাদের মতামত নিয়েই এটা করা হচ্ছে। তাদের ধারণা এমন যে, এটা (লকডাউন) আমরা যদি ছোট ছোট এলাকা ধরে করি তাহলে সংক্রমণটা কমানো সম্ভব হবে।


সূত্র: বিবিসি বাংলা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //