প্রশ্নবিদ্ধ ওয়ারী লকডাউন

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশ ওয়ারীতে লকডাউন চলছে। গত ৪ জুলাই শুরু হওয়া এ লকডাউন চলবে ২৫ জুলাই পর্যন্ত। লকডাউনের আওতাধীন সড়কগুলো হলো- টিপু সুলতান রোড, যোগী নগর রোড, ঢাকা সিলেট মহাসড়ক (জয়কালী মন্দির থেকে বলধা গার্ডেন), লারমিনি স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, র‌্যাংকিন স্ট্রিট ও নবাব স্ট্রিট। বিশেষ প্রয়োজনে যাতায়াতের জন্য র‌্যাংকিন স্ট্রিট ও ওয়্যার স্ট্রিট অর্থাৎ হট কেকের গলির গেট খোলা রাখা হয়েছে। আতঙ্কে ওয়ারীর অনেক বাসিন্দা লকডাউনের দু’দিন আগেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। যারা ওয়ারীতে আছেন তারাও প্রতিদিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন।

নির্দিষ্ট সড়কের প্রবেশমুখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লকডাউন মানতে প্রয়োজনে বাধ্য করা হবে তাদের। তবে সংক্রমণ যেখানে পুরো শহর এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে ওয়ারীর লকডাউন বিশেষ কোনো সুবিধা দেবে বলে মনে করছেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াচ্ছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। বরং এ দিকটাতে দেশজুড়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। 

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি রোড ও গলির প্রবেশ মুখ বাঁশের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জরুরি খাদ্য সরবরাহ, ওষুধের দোকানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সাংবাদিকদের ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে এবং বের হতে দেয়া হচ্ছে না। তবে স্থানীয়দের অনেকেই নিয়ম-নীতি ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছেন না। তারা বলছেন, এই এলাকায় তাদের অনেকেরই ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ জন্য তারা লকডাউন চান না। বাধা দিলে স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন অনেকেই। 

তবে পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভেতরের ওষুধের দোকান, সুপার শপ, হাসপাতাল খোলা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করছেন। সকালের দিকে রাস্তায় দু’একজনের চলাচল থাকলেও বিকেলে অনেকটা ফাঁকা ছিল। একটু পরপর পুলিশের মোবাইল টিমের সদস্য, টহল টিমের সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবকরা এলাকা পরিদর্শন করছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এ লকডাউনকে কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। অনেকেই আবার একে দেখছেন অহেতুক ভোগান্তি হিসেবে। 

লারমিনি স্ট্রিটে বসবাস করেন মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ওয়ারীতে লকডাউন দেয়া মানে হয়রানি। এই লকডাউনের কোনো অর্থ নেই। যারা বাইরে যাওয়ার তারা ৪ জুলাইয়ের আগেই চলে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কভিড-১৯ আক্রান্ত থাকলে অন্য এলাকায় গিয়ে রোগ ছড়াবে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি, তাদের ব্যবসা বন্ধ, সবকিছু বন্ধ। মোটকথা আমরা ভোগান্তির মধ্যেই পড়ে আছি।’

বিভিন্ন প্রবেশমুখের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নবাবপুর, ইসলামপুরের অনেক ব্যবসায়ী ওয়ারী এলাকায় বসবাস করেন। তারা বাইরে বের হতে চাচ্ছেন বেশি। কেউ বলছেন, ব্যাংকে আমার লোন আটকে যাবে; কেউ বলছেন, কোর্টে মামলার শুনানি আছে; কেউ টিভি মেরামত করতে যেতে চাইছেন, আবার কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে চাইছেন। এ ছাড়াও নানা কারণ দেখিয়ে লোকজন বাইরে বের হতে চাইছেন। তবে উপযুক্ত কারণ ছাড়া কাউকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। নবাব স্ট্রিটের স্বেচ্ছাসেবক সালাম বলেন, ‘কাজের গুরুত্ব দেখিয়ে অনেকেই বাইরে যেতে চাইছেন; কিন্তু জরুরি চিকিৎসাসেবার বিষয় ছাড়া কাউকে আমরা ভেতরে আসতে এবং বাইরে যেতেও দিচ্ছি না।’

৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সারওয়ার হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয়দের খাবারের চাহিদা মেটাতে মীনা বাজার, বিগ বাজার ও স্বপ্ন এ তিনটি সুপার শপের আউটলেট খোলা রয়েছে। তা ছাড়া ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে এই তিনটি সুপার শপের চুক্তি হয়েছে, তারা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে বাসিন্দাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেবেন। এ ছাড়াও এলাকায় দশটি ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করা হচ্ছে। সেখানে বাজার মূল্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম দামে সবজি বিক্রি করা হবে। এ জন্য সবজি বিক্রেতা কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা সহযোগিতা পাবেন।

এ বিষয়ে ওয়ারী থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. জহির হোসেন বলেন, ‘জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেয়া হচ্ছে না। সাংবাদিক, পুলিশ, ডাক্তার, নার্স বের হতে বা প্রবেশ করতে পারছেন।’

পুরান ঢাকার ওয়ারীর লকডাউন এলাকার কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে রয়েছেন ডিএসসিসির অঞ্চল-৫-এর সমাজকল্যাণ দপ্তরের প্রশিক্ষক নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ওয়ারীর ওই এলাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ওয়্যার স্ট্রিটে এবং র‌্যাংকিন স্ট্রিটে পৃথক দুটি ফটক রাখা হয়েছে। সেখানে শুধু জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের তাপমাত্রা মেপে ভেতরে ঢুকতে এবং বের হতে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। বাকিদের আটকে দিচ্ছেন। র‌্যাংকিন স্ট্রিটে ওয়ারী বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফটকের সামনে টানানো বড় ব্যানারে লেখা- ‘যদি জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অথবা স্বাদ-ঘ্রাণ না পাওয়া এই উপসর্গগুলোর কোনোটি দেখা দেয়, এই বিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করুন।’ বিদ্যালয়টির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় করোনাভাইরাস পরীক্ষায় বুথ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে নমুনা সংগ্রহ করছেন ব্র্যাকের হেলথ প্রোগ্রামের কর্মীরা। দুটি অ্যাম্বুলেন্সও রাখা হয়েছে। আইইডিসিআরের তত্ত্বাবধানে এই বুথ পরিচালনা করছেন তারা।

গত ৬ জুলাই সকাল ৯টায় বলধা গার্ডেনের প্রবেশমুখে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন শাকিবুল হাসান। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এভাবে লকডাউনের কোনো মানে নেই। গার্মেন্টস খুলবেন, ঈদে লোকজনকে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দেবেন; আবার সামনে পশুর হাট বসবে। এরপর রেড জোনের নামে লকডাউন শুধু শুধু আমাদের হয়রানি করা।’ 

র‌্যাংকিন স্ট্রিটের প্রবেশপথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের কড়াকড়ি দেখা গেলেও গেলেও স্থানীয়দের যাতায়াতও ছিল চোখে পড়ার মতো। গত ৪ জুলাই সারাদিন ১৪৮ জনের যাতায়াতের তথ্য লিপিবদ্ধ থাকলেও ৫ জুলাই ১৭০ জনের যাতায়াতের তথ্য মিলেছে। আর ৬ জুলাই এই পরিসংখ্যানটি গিয়ে দাঁড়ায় ২০০ জনে।

সুমিজ হট কেকের প্রবেশমুখে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা নাজমুল হাসান জানান, ‘প্রথম দিক বলে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা পুরো ওয়ারীতে এখনো মাইকিং করছি। লিফলেট দিচ্ছি যাতে কেউ ঘর থেকে না বের হয়। যে কোনো প্রয়োজনে তাদের কাছে দেয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য।’

ওয়ারীর লকডাউন নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের এখন যে অবস্থা, তাতে প্রত্যেকটি অঞ্চলে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তা লকডাউন দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব না; বরং যেটা করতে হবে- বেশি বেশি করে মানুষজনকে স্বাস্থ্য সচেতন করার প্রতি জোর দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি নিজে সুরক্ষিত থাকতে পারে, তা হলেই কেবল মহামারি থেকে বাঁচতে পারব।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //