স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সম্পদের খোঁজে দুদক

করোনাভাইরাস মহামারির ফলে বাংলাদেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মুখ থেকে যেন খসে পড়েছে চাকচিক্যের আবরণ, আর বেরিয়ে এসেছে রোগা জীর্ণশীর্ণ এক ব্যবস্থা- যা এতদিন সেই অর্থে দৃশ্যমান হয়নি সাধারণ মানুষের চোখে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই এসব হয়েছে। তবে সব সমস্যার মূলেই রয়েছে দুর্নীতি। 

সরকারি খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে এবার নড়ে চড়ে বসেছে রাষ্ট্রীয় এই দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের ধরতে মাঠে সক্রিয় দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা। দুদকের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাম্প্রতিক দেশকালকে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত অন্তত দেড় শতাধিক বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা। 

তারা আরো জানান, এর মধ্যে যেসব কর্মকর্তার অবৈধ বা প্রাথমিক দৃষ্টিতে সম্পদের পরিমাণ অস্বাভাবিক মনে হয়, তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানে নামছে দুদক। তবে কোনোভাবেই যেন কেউ হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়েও কড়া নির্দেশনা রয়েছে দুদক কর্মকর্তাদের প্রতি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দারা মাঠে নামার আগে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেড় শতাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা তৈরি করেছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। সূত্র জানায়, এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, অবৈধ সম্পদসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

আর চলমান মাস্ক, পিপিই ও ভুয়া কোভিড-১৯ টেস্ট নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতাল-জিকেজি কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান ও সাবেক বেশকিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে মুখোমুখি হতে হবে দুদকের জেরার। কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট মামলার আসামি হয়ে গ্রেফতারও হতে পারেন। এই তালিকায় রয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েক ডজন কর্মকর্তা এবং সরকারি মেডিক্যাল কলেজের বেশ কয়েকজন পরিচালক ও অধ্যক্ষ। 

এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মের বিষয়ে দুদক জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। দুদকের কাছে কোনো অভিযুক্তই বড় বা ছোট নয়, সবাই ‘অভিযুক্ত’।” তালিকা প্রণয়ন ও গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে চাননি। ‘গোয়েন্দাদের কাজই মাঠে ঘাটে তথ্য খুঁজে বেড়ানো’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দুদকের সুপারিশ অন্ধকারে

স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করতে ২৫ দফা সুপারিশসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল দুদক। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মুখও খুলছে না মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা। বহু চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য।

অন্যদিকে দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘দুর্নীতি রোধে ২৫টি সুপারিশ করে বলেছিলাম, এই কাজগুলো যদি করা হয় তাহলে দুর্নীতি হবে না; কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সে কাজগুলো করতে পারেনি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, “দুদকের দেয়া সুপারিশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা, তা দুদকের জানা নেই। খুব দ্রুতই এই বিষয়টি ‘রিভিউ’ করার কথা ভাবছে কমিশন।”

দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশ

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশ করেছে দুদক। এর মধ্যে রয়েছে- প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় এমন উন্মুুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের বিধান নিশ্চিত করা। পাশাপাশি হাসপাতালে কী কী ওষুধ স্টকে আছে, তা প্রদর্শন করা।

ওষুধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতি এবং অনিয়ম বন্ধ করার জন্য ক্রয় কমিটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। জনবল না থাকলে যন্ত্রপাতি কেনা উচিত নয়। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে ইজিপিতে টেন্ডার আহ্বান এবং পিপিআরের বিধানের যাতে ব্যত্যয় না ঘটে, তা যথাযথভাবে পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।

হাসপাতাল পর্যায়ে যন্ত্রপাতি গ্রহণ করার জন্য গঠিত কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে যন্ত্রপাতি গ্রহণ করার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার স্বার্থে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়েই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার বিধান করতে হবে। চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে প্রতিটি হাসপাতালে সরকারনির্ধারিত ওষুধের তালিকা এবং ডায়াগনোসিস পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য তালিকা জনসমক্ষে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়া হাসপাতালে বিদ্যমান মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির হালনাগাদ তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা উচিত। পর্যায়ক্রমে সব হাসপাতালে ই-রেজিস্টার চালু করার কথাও তারা বলেছে।

সংঘবদ্ধ দালালচক্র প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি ও তদারকির সুপারিশ করেছে দুদক। জেলা-উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো অনুমোদনহীন অনেক প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। অনেক হাসপাতালে প্রয়োজন অনুপাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় এবং প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি নেই। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা ল্যাব টেকনিশিয়ান নেই। অনেক সময় সনদবিহীন টেকনিশিয়ান দিয়ে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট তৈরি করা হয়।

দুদক সুপারিশ করেছে- অনুমোদনহীন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে সিভিল সার্জনদের নেতৃত্বে শক্তিশালী নজরদারি কমিটি গঠন করতে হবে। নকল ওষুধ ও কারখানার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

সুপারিশের ছয় মাস পর কালো তালিকায় ১৪ ঠিকাদার

বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে সুপারিশ করে চিঠি দেয় দুদক। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকায় যুক্ত করতে ছয় মাসেরও বেশি সময় নেয় মন্ত্রণালয়।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে যখন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তখন জুলাই মাসের শুরুতে এই ১৪ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো ও এর মালিকরা হলেন- রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, স্বত্বাধিকারী রুবিনা খানম। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক মো. আবজাল হোসেনের স্ত্রী।

এছাড়া মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মুন্সী ফররুখ হোসাইন, মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড মেসার্স এস কে ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মনজুর আহমেদ, এমএইচ ফার্মার স্বত্বাধিকারী মোসাদ্দেক হোসেন, মেসার্স অভি ড্রাগসের স্বত্বাধিকারী মো. জয়নাল আবেদীন, মেসার্স আলবিরা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী মো. আলমগীর হোসেন, এস এম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. মিন্টু, মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুস সাত্তার সরকার ও মো. আহসান হাবিব, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো. জাহের উদ্দিন সরকার, ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মো. আসাদুর রহমান, এ এস এলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আফতাব আহমেদ এবং বেয়ার এভিয়েশনের স্বত্বাধিকারী মো. মোকছেদুল ইসলাম।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //