মুখোশে লজ্জা ঢেকে মাংস কুড়ানির দলে মধ্যবিত্ত

‘যে বালিকাটি ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে কারখানা অভিমুখে, চোখ আর আঙুল জীর্ণ করে শেলাই করছে সভ্যতার মুখোশ, তার সঙ্গে সভ্যতা যেন সভ্য আচরণ করে; তাকে দেয় খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা। ক্রীতদাসী না করে তাকে যেন দেয় মানুষের মর্যাদা, যা তার প্রাপ্য সহজাতভাবে।’ 

জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদের এই উক্তিটি মাথায় বেশ আঘাত করছিল ঈদুল আজহার দিন কিছু মানুষকে দেখে। মহামারি করোনাভাইরাস যাদের সব কেড়েছে। সপরিবারে বন্দি করেছে পালিত বিহঙ্গের মতো। কাজ নেই, পকেট খালি; কিন্তু পেট তো আর মধ্যবিত্ত নয়। ফাঁকা হলেই সংকেত দেয়। 

ঈদ ঘিরে ছোট ছেলে-মেয়েদেরও রাজ্যের আবদার। আচমকাই রুটিরুজি হারিয়ে এভাবে অসহায় হয়ে পড়তে হবে- তা কল্পনাই করেনি মধ্যবিত্ত। কঠিন এই দিনে চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও যে নেই। কিছু আমিষ জোগাতেই বেরিয়ে পড়েন ব্যাগ হাতে। মুখোশে (মাস্ক) নিজেকে আড়াল করে মিশে যান মাংস কুড়ানি নিম্নবিত্তের স্রোতে। মাস্কের কী মাহাত্ম্য- লজ্জা আর জীবাণু দুটোকেই সহজে আড়াল করে নেয়।

রাজধানীর খিলবাড়িরটেক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন হোমিও চিকিৎসক সিরাজুল ইসলাম (নাম পরিবর্তিত)। তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়েই সংসার। ভালোই চলে তার চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিক্রি। টাকার জন্য ঠেকতে হয়নি কখনো। প্রতি ঈদেই খরচ করেছেন সাধ্যমতো। এমন কোনো বছর নেই কোরবানি দেননি। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে মাংস বিলিয়েছেন গরিবের মাঝে। এবার নিজেই তাদের দলে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়। তাদের কখনোই খাবারের কষ্ট করতে দেইনি। এখন খাবার টেবিলে বসলে কান্না আসে। তাই ঈদের জামাত পড়েই অন্য এলাকায় ঘুরে ঘুরে কিছু মাংস চেয়ে এনেছি। স্ত্রী ও সন্তানরা অবশ্য জানে সেগুলো প্রতিবেশীরা দিয়েছে। আপনিই বলুন- আমি যে আজ ভিক্ষুকের মতো মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, এ কথা কি তাদের বলা যায়?’

পাল্টে গেছে জীবনের সংজ্ঞা

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশাল আর্থিক সংকটের মুখোমুখি গোটা বিশ্ব। ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। চাকরি হারিয়েছেন অনেকেই, থমকে গেছে ব্যবসা। আবার চাকরি থাকলেও বেশিরভাগেরই বেতন নেমে এসেছে অর্ধেকে। তবুও জারি রয়েছে বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অন্যান্য রসদও। নতুন করে যোগ হয়েছে ভাইরাস মোকাবেলায় সুরক্ষা ব্যবস্থা। 

যেটুকু জমানো টাকা ছিল, গত তিন-চার মাসেই শেষ। সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে এখন না পারছেন নিজেদের অভাব-অনটনের কথা প্রকাশ করতে, না পারছেন চলতে। ফলে বাধ্য হয়েই শহর ছাড়ছেন কেউ কেউ। নিরুপায় হয়ে হাত পাতছেন আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছে। কখনো-সখনো দাঁড়াচ্ছেন ত্রাণের লাইনেও। তবে সব হারালেও চিরকাল মাথা উঁচু করে পথচলা মানুষগুলো তো আর আত্মসম্মানবোধ বিকিয়ে দেননি। পথে তাই পরিচিতজন দেখলেই মাস্ক পরা মুখ আরও ভালো করে ঢেকে নেন সাথে থাকা গামছা কিংবা কাপড় দিয়ে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্ত সমাজ অবশ্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে! পৃথিবীর কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝাই তাদের স্পর্শ করতে পারে না! অঢেল পয়সা থাকায় মজুদ করে নিতে পেরেছেন বিপুল খাদ্যসামগ্রী। আর যারা করতে পারেননি, কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে এখন কিনছেন; যা গায়েই লাগছে না। আর নিম্নবিত্ত দয়া-দাক্ষিণ্যেই দিন কাটাচ্ছে। 

কেবল দিন যত যাচ্ছে, ততই অসহায় হয়ে পড়ছে মধ্যবিত্ত সমাজ। তাদের নিয়ে ভাবার সময়ও নেই কারও। এই শ্রেণির যাপনই শুধু নয়, জীবনকেও সরাসরি বিপন্ন করেছে করোনাভাইরাস। পাল্টে দিয়েছে জীবনের সংজ্ঞাটাও। তাই আত্মহত্যা, মানসিক অবসাদ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে বিবাহবিচ্ছেদ।

অনেকেই কখনো না কখনো অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চান; কিন্তু সেই চাওয়ার সাথে এই পরিস্থিতির একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। এখন যারা সাহায্য চাইছেন, তারা নিজেরাই জানেন না, এর শেষ কোথায়। এতটাই অনিশ্চিত তাদের আর্থিক ভবিষ্যৎ। আবার সবাই তো আর অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে পারছেন না, কিংবা পারেনও না। আত্মসম্মানে বাধে। এক কথায় বলতে গেলে- মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিশ্বায়িত ভোগবাদে সব সময়ই মার খায় মধ্যবিত্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. দেবাশীষ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘মধ্যবিত্তের বড় ভয় অনিশ্চয়তা। যেখানে আছে সেখান থেকে নেমে যাওয়ার ভয়। লোকাল বাসের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে মানুষগুলো এরই মধ্যে দারিদ্র্যসীমার হাতল ধরে ঝুলছেন। তাদের চাকরি এরই মধ্যে চলে গেছে, বা যাই যাই করছে, কিংবা আপাতত আর কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। তাদের যেখানে চাল, ডাল, তেল, নুনের হিসাব মিলছে না; সেখানে মাস্ক, গ্লাভস, সাবান, স্যানিটাইজার কেনার বাড়তি খরচ কীভাবে জোগাড় হবে? অনিশ্চয়তা আরো প্রকট আকারে হাজির হয়েছে, যাকে সাথে করেই পাড়ি দিতে হবে অন্তহীন ভবিষ্যৎ।’

আয়-ব্যয়ের গ্যাঁড়াকলে চিড়েচ্যাপ্টা

দেশের গতিময় অর্থনীতিতে সাওয়ার হয়ে দরিদ্র শ্রেণি থেকে বিশাল একটি অংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পৌঁছেছিল; কিন্তু করোনাকালে সেই চাকাটাই উল্টোপথে চলেছে। তাই আবার সেখানেই নামতে হয়েছে ওই শ্রেণিটিকে, আর দরিদ্ররা হচ্ছেন চরম দরিদ্র। 

গবেষকরা জানিয়েছেন, মার্চের শুরুর দিকে দেশে যেখানে দরিদ্রদের সংখ্যা ২১ শতাংশের মতো ছিল, সেটি এখন দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে। অর্থাৎ, আগে যেখানে নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি, সেটি এখন সাড়ে ছয় কোটির ঘরে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে মধ্যম আয়ের লোকের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে প্রায় ৮০ লাখ। এরা নিজেদের আয়, দৈনন্দিন খরচসহ সন্তানদের পড়াশোনা, ভ্রমণ, বিনোদন, চিকিৎসাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে কিছু সঞ্চয়ও করতে পারে। তাদের একটি বড় অংশ ছোটখাটো ব্যবসার সাথে জড়িত, আরেকটি চাকরিজীবী। অপর একটি অংশ পৈতৃক সূত্রে অর্জিত সম্পদ দেখভাল করে জীবিকানির্বাহ করছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একরকম স্থবির। 

তাই বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, আয় কমেছে ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষের। এর মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে দেখা যায়, আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা ১৩ শতাংশ লোক চাকরি হরিয়েছেন করোনাকালে। আর যাদের উপার্জন ১১ হাজার টাকার কম, তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, কমে গেছে ৩২.১২ শতাংশের। ১৫ হাজার টাকার মধ্যে যাদের আয়, তাদের মধ্যে ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, ৪৭.২৬ শতাংশের কমে গেছে। পাশাপাশি যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের বন্ধ হয়ে গেছে। 

শুধু দেশেই নয়, প্রবাসে যারা কাজ করতেন, তাদের একটি বড় অংশই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরছেন। বড় সংকটে পড়েছে তাদের পরিবারও। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের অভিঘাতে রীতিমতো ‘চিড়েচ্যাপ্টা’ মধ্যবিত্ত।

সৌদি আরবে ভাড়ায় গাড়ি চালান মাদারীপুরের রবিন আহসান। করোনাভাইরাস সংকটে দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে বের হতে পারেননি রাস্তায়। এর মধ্যে কোনো কফিল (মালিক) না থাকায় নিদারুণ কষ্টে কাটছে সময়গুলো। বাড়িতে টাকা পাঠানো তো দূরের কথা, নিজেই পেটপুরে খেতে পারেন না। তাই সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ঈদের দিন বোরকার আড়ালে মুখ ঢেকে রাস্তায় নেমেছিলেন ঢাকায় থাকা তার স্ত্রী রাহেলা বেগম (নাম পরিবর্তিত)। পরিচিতজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চেয়ে এনেছেন কোরবানির মাংস। 

ওই নারী বললেন, ‘বাচ্চারা তো আর কষ্টের কথা বুঝে না। ঈদ এলে নানা আবদার করে। হাতে কয়েকটা টাকা ছিল, তা দিয়ে ওদের জামা কিনে দিয়েছি। মাংস কেনার মতো টাকা না থাকায় কয়েকজনের বাসা থেকে এনে ছেলে-মেয়েদের রান্না করে দেই। এমন অবস্থা আর কখনোই হয়নি আমাদের। প্রতিবারই কোরবানি দিয়েছি, ভাগে হলেও দিয়েছি।’

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। তারা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে ঈদ উপলক্ষে যে কেনাকাটা হতো সেটিও এবার কম হয়েছে। আগে যারা গরু কোরবানি দিতেন এবার তারা হয়তো খাসি কোরবানি দিয়েছেন। যিনি লাখ টাকার গরু কিনতেন এবার তিনি হয়তো ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনছেন। সব মিলিয়ে এর সামাজিক প্রভাবটা বেশ খারাপ। এতে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যদি না নতুন কৌশলের মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা হয়।’

অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা মধ্যবিত্তের। তাদের আয় কমেছে, অনেকেরই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এখন আর আয় বাড়ানোর পথ নেই। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে কাজ হারানো লোকজনকে সাপোর্ট দিতে হবে। পাশাপাশি পরিস্থিতির উন্নতি হলে কীভাবে তারা আগের কাজে ফিরে যেতে পারে, সে চেষ্টাও করতে হবে।’ 

ভুল তথ্যে মাথায় হাত

ঢাকার মানুষ গরু কেনা শুরু করে ঈদের দুদিন আগে থেকে। কারণ এই জনবহুল শহরে গরু রাখার মতো জায়গার বড্ড অভাব। অথচ ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই সংবাদমাধ্যমগুলো বলতে শুরু করে- করোনার কারণে মানুষের সামর্থ্য কমে গেছে। সংক্রমণ আতঙ্কে উচ্চবিত্ত। তাই এবার গরু কেনাবেচা হবে কম। ফলে অনেকেই আতঙ্কে ঢাকায় গরু আনেনি। আবার যারা এনেছিলেন তারাও ভয়ে কম দামে ছেড়ে দেন আগেভাগেই। শেষমেশ কোরবানির জন্য পশুই পাওয়া যায়নি। 

দু’পক্ষেরই মাথায় হাত। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই কোরবানি দিতে পারেননি। এমনকি যারা গরু কিনতে চেয়েছিলেন, না পেয়ে তারা ছাগল কিনতে বাধ্য হন। কেউ কেউ তাও পাননি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //