কভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি

এক মাস আগে এখানে চীনা ভ্যাকসিন পরীক্ষার অনুমোদন চাওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাগজই যাচাই করে দেখতে পারেনি সরকার। এ কথা সবাই জানেন- অন্য কিছুতে নয়, ভ্যাকসিনেই নির্মূল হবে করোনাভাইরাস। গবেষণার পর্যায়ে থাকা কোনো ভ্যাকসিনই এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি। তা সত্ত্বেও অনেক দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ভ্যাকসিন আগাম ক্রয়ের আদেশ দিয়ে রেখেছে। ভ্যাকসিনের গুরুত্ব সরকার স্বীকার করলেও, কীভাবে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে এবং কোথা থেকে আসবে, কোন কোম্পানির ভ্যাকসিন কিনবে- এ সিদ্ধান্ত এখনো নিতেই পারেনি। কার্যত বাংলাদেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়েও চলছে রাজনীতি।

চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটি ট্রায়ালের জন্য আইসিডিডিআরবির প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) অনুমোদন পেলেও বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন এখনো পায়নি। সরকার গত এক মাসেও অনুমোদন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে সিনোভ্যাকের ওই ভ্যাকসিন ট্রায়াল বাংলাদেশে রাজনীতির মার-প্যাঁচে পড়ে গেছে। 

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি ও প্রাপ্তির দৌড়ে রয়েছে বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশ। এসব দেশ যেমন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি তাদের রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি। ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে এগিয়ে থাকা সবচেয়ে আলোচিত নামটি হলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাজ্যের এস্ট্রাজিনেকা ও চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানি। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর। এ ছাড়া ব্রাজিলে পাঁচ হাজার ও দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপরও এ ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চালানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি আলোচনায় রয়েছে রাশিয়ার ভ্যাকসিনটিও। তবে রাশিয়ার ভ্যাকসিনের প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনাই সর্বত্র হচ্ছে। কারণ এ ভ্যাকসিন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল না দিয়েই উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। এ ছাড়া এ ভ্যাকসিন কীভাবে তৈরি হচ্ছে, এর তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দেওয়া হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সার্টিফিকেট না দিলে কোনো ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা যায় না। যদিও রাশিয়া বলছে, তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের ১০০ কোটি ডোজের অর্ডার পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ১০টি কোম্পানিকে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি নেই।


ভ্যাকসিন দৌড়

ভ্যাকসিন প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গেল বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে বিশ্বের ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য ভ্যাকসিনের আগাম ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে। যেমন- ব্রিটেন ১০ কোটি ডোজ, যুক্তরাষ্ট্র ৩০ কোটি ডোজ। তারা তাদের নাগরিকদের বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিয়ে দেবে। ফলে নিরাপদ হয়ে যাবে তারা। বাংলাদেশ তার নাগরিকদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে কী করছে? সাধারণত ভ্যাকসিন পাওয়ার অগ্রাধিকার তৈরি হয় সংশ্লিষ্ট ভ্যাকসিন তৈরিতে অংশ নিলে। এর সহজ উপায় হলো কোনো ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে অংশ নেওয়া। তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তা যেমন জেনে নেওয়া যায়, তেমনি ভ্যাকসিন পাওয়ার অগ্রাধিকারও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি উদ্যোগ নেওয়ায় সিনোভ্যাক এখানে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা করতে রাজি হয়; কিন্তু সরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে গত এক মাস যাবত সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন প্রক্রিয়াটি ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে গেলাম। গত ২২ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ১০টি ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে অক্সফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না এবং চীনের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটিও ছিল। ডব্লিউএইচও এই ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে জানে।’ সিনোভ্যাকের এই ভ্যাকসিনটিকে অধ্যাপক নজরুল ‘ভালো ও ক্লাসিফাইড ভ্যাকসিন’ বলে মনে করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘এই ভ্যাকসিনটির তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্য আইসিডিডিআরবির প্রস্তাবনায় অনুমোদন দিয়েছে বিএমআরসি। এখন লাগবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন। গত একমাসেও সরকার অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। তার মানে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও এক মাস পিছিয়ে গেল।’

করোনা থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্তি পেতে গেলে ভ্যাকসিন অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চীনের যে ১৫ চিকিৎসকের দল বাংলাদেশে এসেছিলেন, তারা এই ভ্যাকসিনটা সম্পর্কে ভালো বলে গেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল হলে তিনি প্রথম স্বেচ্ছাসেবক হবেন। এতে বোঝা যায় ভ্যাকসিনটা বেশ ভালো হবে।’

সিনোভ্যাককে ট্রায়াল দিতে না দেওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বেশকিছু ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। এ ছাড়াও ভারত বায়োটেকসহ সাতটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের। এদের অনেকেই দ্বিতীয় পর্যায়ের ভ্যাকসিন ট্রায়াল দিয়েছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন তৈরি করবে মহারাষ্ট্রে পুনের সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। সংস্থাটির প্রধান আদার পুনাওয়ালার সূত্রে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফল হলে নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে ভ্যাকসিন এসে যেতে পারে। সাধারণের ব্যবহারের জন্য আগামী বছরের জানুয়ারিতে বাজারে আসতে পারে। তারা যে পরিমাণ ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে এর অর্ধেক ভারতের জন্য রেখে অবশিষ্ট বাইরে বিক্রি করবে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ভারতের তৈরি ওই ভ্যাকসিনের জন্যই হয়তো বাংলাদেশে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে। এখানে ভারতীয় রাজনীতির পাশাপাশি রয়েছে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ। এক ডোজ ভ্যাকসিনের বাজারমূল্য হতে পারে এক হাজার টাকা। দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৭০ শতাংশের (প্রায় ১২ কোটি ডোজ) জন্য ভ্যাকসিন প্রয়োজন হতে পারে। বিশাল আর্থিক হিসাব-নিকাশের কারণেই বাংলাদেশে ভ্যাকসিন ট্রায়াল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে বলে অনেক চিকিৎসকরা বলে যাচ্ছেন।

এদিকে, গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘হয়তো বা বেশিদিন লাগবে না, বাংলাদেশ থেকে কভিড (করোনাভাইরাস) চলে যাবে। ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে কি না জানি না।’ এ নিয়ে বিতর্কে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তিনি কি টিকা আনার বিপক্ষে? তিনি কি চান না বাংলাদেশে টিকা আসুক?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস ভীষণ সংক্রামক এবং এটি যতদিন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে থাকবে, ততদিন এর মিলিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শুধু ভ্যাকসিন দিয়েই করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে এমনিই চলে যাবে- এমন কথা যৌক্তিক বা বিজ্ঞানসম্মত নয়। একটা দেশের স্বল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠী যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলেন, তাহলেও সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এমনকি অন্য দেশেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থাকলে যোগাযোগের কারণে বাংলাদেশে তা সংক্রমিত হবেই। এই ভাইরাসটি নিজ থেকে চলে যেতে পারে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //