মানুষের ঢাকা ছাড়ার ঢল

চ্যালেঞ্জে গ্রামীণ অর্থনীতি

মোহাম্মদ ফয়সাল রাজধানীর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চাকরি হারান গত মে মাসে। পরিবার নিয়ে যেন মাঝ নদীতে পড়েন ফয়সাল! উপায় না পেয়ে বাড়ির মালিককে ভাড়া কমানোর কথা বলেন। ভাড়া কমানোর বিষয়ে কোনো লক্ষণ না দেখে ঢাকা ছেড়ে পরিবার নিয়ে কুষ্টিয়ায় চলে যান ফয়সাল। ফয়সালের সঙ্গে কথা হয় সাম্প্রতিক দেশকালের। তিনি বলেন, ‘চাকরি নেই কী করব, উপায় না পেয়ে ঢাকা থেকে চলে এলাম। এভাবে তো ঢাকায় থাকা যায় না। বাড়ি মালিককে ভাড়া কমানোর বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম, কোনো লাভ হয়নি।’ ফয়সাল আপাতত কুষ্টিয়ায় গিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। 

বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়াতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। তার কারণ এসব শহুরে মানুষ যে যার জায়গা থেকে বছরের পর বছর ধরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে আসছে। এই শহরবিমুখিতায় তারা খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে।


অধ্যাপক এম এম আকাশ

অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পুরান ঢাকায় থাকতেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুজাহিদ। কয়েকজন বন্ধু মিলে সেখানে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। করোনাভাইরাসে প্রাইভেট টিউশনি হারান। প্রথম বাড়ি থেকে টাকা এনে তিন মাসের ভাড়া দিয়েছিলেন। পরে কয়েক বন্ধু মিলে বাড়ির মালিকের কাছে যান ভাড়া কমাতে; কিন্তু মালিক অনড়। বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে খুলনায় বাড়িতে চলে যান মুজাহিদ। তিনি বলেন, ‘ইনকাম নেই, কাজ নেই, শুধু শুধু বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ভাড়া মেটানো লাগছিল; কিন্তু মালিকের সহানুভূতি পাইনি। উপায়ান্তর না দেখে বাড়ি চলে এসেছি। ঢাকা স্বাভাবিক হলে আবার এসে বাসা খুঁজে নিতে হবে।’

ফয়সাল কিংবা মুজাহিদদের গল্প এ শহরের হাজারো মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। অন্তঃহীন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পরও গ্রামে ফিরছে সবাই। শহরের বাড়িগুলোতে টু-লেটের সংখ্যা বাড়ছে। অসংখ্য মানুষের চাকরি চলে গেছে। আবার কারও বেতন কমে গেছে। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অর্থিক সংকটে পড়ে রাজধানী ছাড়ছে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেক ভাড়াটিয়া ঢাকা নগরী ছেড়ে গেছেন। অনেকে কম ভাড়ার বাড়িতে উঠেছেন। সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় দুর্যোগ কেটে গিয়ে কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার বাড়িওয়ালারা, যারা শুধু বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল তারা ভাড়া কমিয়ে ভাড়াটিয়া ধরে রাখার কৌশল নিয়েছেন। কোনো কোনো বাড়িওয়ালা কমিয়েছেন সার্ভিস চার্জ। অনেকে ভাড়া না কমিয়ে অপেক্ষা করছেন, ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়ার নোটিশ দিলে কমাবেন। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুসারে, ঢাকা শহরে মোট বাড়ির সংখ্যা তিন লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে উত্তরে সব মিলিয়ে এক লাখ ২০ হাজার এবং দক্ষিণে এক লাখ ৫০ হাজার। দক্ষিণের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে (পুরনো পাঁচ ইউনিয়ন) বাড়ির সংখ্যা আরও ৭০ হাজার। ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করে ভাড়াটিয়া পরিষদ। ওই পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার জানান, ‘আমাদের কাছে ভাড়াটিয়াদের যে তথ্য-উপাত্ত রয়েছে তাতে দেখা যায়, ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটি ৩৬ লাখ মানুষ ভাড়া থাকে। কারোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার ভাড়াটিয়া ঢাকা ছেড়েছেন।’

পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া অনেকগুণ বেড়েছে। এরই মধ্যে খাবার খরচ, শিক্ষা, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ বিল, গ্রামে থাকা মা-বাবার দেখভাল আর মোবাইল বিল খরচ করে পকেটে আর কিছুই থাকে না। প্রতি মাসের শেষ কটা দিন ধারদেনা করে চলেন অনেকে, নেই কোনো সঞ্চয়, তাই এই বাড়িভাড়ার চাপেই শহর ছাড়ছে মানুষ। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে যাবেন বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিসংখ্যান মতে, দেশে ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ছয় কোটি আট লাখ মানুষ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, করোনাভাইরাসে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ গরিব হয়েছেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে যুক্ত হওয়া নতুন এ সংখ্যার ফলে এখন দেশে গরিব মানুষ পাঁচ কোটিরও বেশি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালকের আশঙ্কা, অর্থনীতির যে স্থবির অবস্থা, তা যদি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের ওপর মূল চাপ কতটা পড়বে কিংবা তারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নির্ভর করবে অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়ায় তার ওপর। বিআইডিএসের জরিপে বলা হচ্ছে, বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে; কিন্তু বেতন নেই। আবার কারও বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে। এসব কারণে অসচ্ছ্বল ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। যার সংখ্যা হবে দেড় কোটি থেকে আড়াই কোটির মতো। এতে আরও বলা হয়, করোনাভাইরাসে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এ অবস্থায় চলতি বছরের তৃতীয় কোয়ার্টারের ওপরই নির্ভর করবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াবে আর মধ্যবিত্ত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

এ বিষয়টি স্বীকার করে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অসংখ্য পরিবার যে কর্মহীন হয়ে ঢাকা ছাড়ছে, সে বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করব না; কিন্তু এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি যে, নির্দিষ্ট কতসংখ্যক মানুষ আসলে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কিন্তু গরিবদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেছে। অর্থনীতি খাতে ভর্তুকি দিয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে।’

তবে বিআইডিএসের জরিপ বলছে, করোনাভাইরাসে ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের আয় কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ করে শহর ছেড়ে গ্রামে মানুষের চলে যাওয়ার কারণে সেখানকার স্থানীয় জীবনযাপনেও সংকট দেখা দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়াতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। তার কারণ এসব শহুরে মানুষ যে যার জায়গা থেকে বছরের পর বছর ধরে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে আসছে। এই শহরবিমুখিতায় তারা খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হয়তো সঞ্চিত আয়ের টাকায় তারা টিকে থাকবে। এরপর তাদের গরিব শ্রেণিতে প্রবেশ করতে হবে। সরকারের উচিত গ্রামীণ ছোট এবং ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা, যাতে এসব মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।’ কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানো উচিত বলেও মনে করছেন এম এম আকাশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যার বাড়িভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, তার এখন আর সেই ক্ষমতা থাকছে না। আর যিনি বাড়িভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন, তিনি বাড়িভাড়া পাবেন না। সামগ্রিকভাবে এই লোকগুলোর সবাই ক্রমান্বয়ে জীবনমানের দিক দিয়ে অনেক নিচে নেমে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। এটাই এই মহামারিতে অর্থনীতিতে অভিঘাতের সবচেয়ে বড় জায়গা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //