বাংলাদেশ
আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৩৯ এএম
আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৪১ এএম
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৩৯ এএম
বাংলাদেশ
আমীন আল রশীদ
আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৪১ এএম
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, লেখক ও শিক্ষক আফসান চৌধুরী গত ২৮ আগস্ট ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন এরকম- ‘রিমান্ডে কী হয়? কারও অভিজ্ঞতা আছে?’
সেখানে প্রায় অর্ধশত মানুষ নানারকম মতামত দেন বা কমেন্ট করেন। এর মধ্যে শামস রুবেল নামে একজন লেখেন- ‘বাটপার শাহেদ আর অপদার্থ প্রদীপ বলতে পারবে।’ নওশিন শর্মিলী নামে আরেকজন লিখেছেন- ‘রিমান্ডে কী হয় সেটা নির্ভর করে কত টাকা ঢালা হচ্ছে তার ওপর।’ নাদিরা খানম লিখেছেন- ‘এমন কিছু হয় যে, খুন না করেও বলে খুন করেছি।’
সুমন এহসানুল ইসলাম নামে একজন এ প্রসঙ্গে একটি গল্প শেয়ার করেন, ‘তরুণ এক পুলিশ নতুন বিয়ে করেছেন। সহকর্মীর সাথে চটুল আলাপে বললেন, কি বিয়া করলাম, বউ তো কথা কয় না। সহকর্মীর উত্তর- রিমান্ডে নে। কথা কইব না মানে, বউয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী কথা কইব।’
এরকম বিচিত্র সব কমেন্ট করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। যার অধিকাংশই রসিকতায় পূর্ণ।
তার মানে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের সাথে কী আচরণ করা হয়, তা মোটামুটি সবাই জানেন। না জানারও কোনো কারণ নেই। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের অনেকেই রিমান্ডে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে বইপত্রও লিখেছেন। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের নাম ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’। অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের একটা বইয়ের নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগস্টের ঘটনা গ্রেপ্তার রিমান্ড ও কারাগারের দিনগুলি’। অধ্যাপক ড. মো আনোয়ার হোসেনের বইয়ের নাম ‘কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’। এরকম আরো অনেকেই বই লিখেছেন।
সুতরাং রিমান্ডে কী হয়, সেটি কারও অজানা নয়। দেশের অত্যন্ত সম্মানজনক মানুষ ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদেরও রিমান্ডে নিয়ে যে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়, সেটিও নতুন কোনো খবর নয়; কিন্তু কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার পুলিশ কর্মকর্তাদের রিমান্ডে নিয়েও যে সেই একইভাবে পেটানো হবে- সেটি বোধ হয় কারও কল্পনায়ও ছিল না; কিন্তু ওসি প্রদীপ এবং পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর টেলিফোন আলাপে সেটি আলোচনায় আসে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওসি প্রদীপ এবং লিয়াকত প্রিজন ভ্যানে কক্সবাজার আদালত থেকে কারাগারে যাওয়ার পথে মোবাইল ফোনে কথা বলেন- যেখানে তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নালিশের সুরে রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ করেন। এর মধ্যে লিয়াকত অভিযোগ করেন, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক তাদের নির্যাতন করিয়েছেন।
এই ভিডিও প্রকাশের পর কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন সামনে এসেছে। যেমন- প্রিজনভ্যানে বসে তারা কী করে তাদের ঊর্র্ধ্বতনকে ফোন
করতে পারলেন? কে এই কথোপকথন রেকর্ড করলেন? রেকর্ড করে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? বিষয়টি নিয়ে অনেকে এমনও সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, মানুষের সহানুভূতি পেতে পরিকল্পিতভাবে ফোনালাপের নাটক সাজিয়ে ভিডিওগুলো ধারণ এবং প্রকাশ করা হয়েছে কি না?
দুই.
জেলখানার ভেতরে মোবাইল ফোনে কথা বলা নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে অনেক প্রতিবেদনও হয়েছে। সুতরাং প্রদীপের মতো একজন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা প্রিজন ভ্যানে বসে মোবাইল ফোনে তার ঊর্ধ্বতনকে রিমান্ডে নির্যাতনের যে অভিযোগ করেছেন, সেটি যদি সাজানো নাটক না হয়, তাহলে এখানে এটি স্পষ্ট যে, রিমান্ড বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদসহ প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রেও মানা হয় না।
সন্দেহভাজন আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল ১৫ দফা নির্দেশনাসহ একটি যুগান্তকারী রায় দেন হাই কোর্ট, যা ২০১৬ সালে বহাল রাখেন আপিল বিভাগও। রায়ে আসামি গ্রেফতারের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু উল্লিখিত দুটি ধারা সংশোধন করে আপিল বিভাগের নির্দেশনা এখনো যুক্ত করা হয়নি। ফলে পুলিশ নানা অজুহাতে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করছে; কখনো জোর করে আসামিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করছে। নির্যাতনে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুও হচ্ছে। প্রশ্ন হলো- রিমান্ডে নির্যাতনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অমান্য করে, তাহলে সেটি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে কি না? নাকি এটিকেও আর দশটি ঘটনার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবজনিত ত্রুটি বলে বিবেচনা করা হবে?
উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের ওই ১৫ দফা নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- আটক ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে পুলিশ তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে। আটক ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন; কিন্তু অনেক সময় আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন বা তারও চেয়ে বেশি রিমান্ডেরও আবেদন জানানো হয়। আবার আদালত তা মঞ্জুরও করেন।
প্রশ্ন হলো- ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতকে রিমান্ডে নিয়ে আসলেই কি নির্যাতন করা হয়েছে? লিয়াকতের ভাষ্য অনুযায়ী, উলঙ্গ করে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে; বুকের পশম তুলে ফেলা হয়েছে- এগুলো কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? যেহেতু ফোনালাপটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে বা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; সে ক্ষেত্রে এটির কি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত নয়? যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, রিমান্ডে নিয়ে আসলেই তাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে এর বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে?
যদি প্রদীপ ও লিয়াকততে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনাটি ‘অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে এর আগে যত লোককে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে; খুন করা হয়েছে- সেসব ঘটনার কি সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে?
প্রসঙ্গত, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু রোধে দেশে একটি আইন আছে। যেখানে বলা হয়েছে, হেফাজতে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।
আইনে আরো বলা হয়েছে, কাউকে হেফাজতে নির্যাতনের ফলে যদি তার মৃত্যু হয়, তাহলে নির্যাতনকারী অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : রিমান্ডে কী হয়? রিমান্ড আসামি পুলিশ
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh