সীমান্ত হত্যা

জবাবদিহির অভাবে ট্রিগার-হ্যাপি কালচার

সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ভারতের গতানুগতিক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের আরেকটি শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলো। মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় বিশেষ ব্যবস্থায় ভারতীয় প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌঁছায়। চার দিনের সম্মেলনের ফলাফলে কোনো নতুনত্ব নেই। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিশেষ কোনো কৌশলও তারা বলতে পারেননি। সীমান্ত এলাকার মানুষের অভিযোগ, সামান্য কারণে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) টার্গেট করে গুলি করে মানুষ হত্যা করে। গুলি চালানোর সময় বিএসএফ সদস্যদের কেউ কেউ মদ্যপ থাকেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। হত্যার পর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যদের কোনো বিচার হয় না। সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না।

বিচারহীনতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো- ফেলানী হত্যার বিচার নিয়ে প্রহসন। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষের গুলিতে মারা যান ফেলানী খাতুন। তার লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিজস্ব আদালতে বিচার শুরু করে। ২০১৩ সালে ওই আদালতে অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটিকে ‘বিচারের নামে তামাশা’ বলে অভিহিত করে। পরবর্তীকালে আপিলেও অমিয় ঘোষ খালাস পান। এরপর একটি মানবাধিকার গ্রুপ ভারতের আদালতে রিট করলেও তার বিচার কাজ অগ্রসর হচ্ছে না। বিগত নয় বছরেও ফেলানী হত্যার বিচার হয়নি। আসল কথা হলো- ভারতের সরকার সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার বিচার করতে চায় না। ১৪ বছরের নিরীহ মেয়ে ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করার পরও বিচার না হওয়ায় বিএসএফ বেপরোয়া হয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রক্ষীদের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের তরফে ‘সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা’র আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে তা হয় না। আশ্বাস আশ্বাসই থেকে যায়।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি স্থল সীমান্ত রয়েছে। এখানে বিএসএফের সদস্যরা অল্পতেই গুলি ছুঁড়ে মানুষ হত্যা করে। ট্রিগার-হ্যাপি কালচার! কারণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা গুলি করলে তাদের কিছুই হয় না। কথিত তদন্তের নামে চলে প্রহসন। বিচারের নামে চলে তামাশা। এভাবে জবাবদিহির অভাবে সীমান্ত হত্যা কমার বদলে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে নিয়মিত বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে। তারা নানা রকমের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া চার দিনের বৈঠকেও গতানুগতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্মেলন শেষে বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা বলেছেন, সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা তাদের দেশের নীতি। তাদের তরফ থেকে এমন বক্তব্য আগেও দেয়া হয়েছে; কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তার উল্টো। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মোতাবেক, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৪৩ জনে দাঁড়ায়। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ২৯ জন।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সীমান্তে নিয়মিত গুলি করে মানুষ হত্যা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। ভারতের তরফে বরাবর অজুহাত দেখানো হয় যে, চোরাচালানের সময় গুলির চালানো হয়। অনেক সময় দুর্বৃত্তরা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলা করলে বাধ্য হয়ে বিএসএফ গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহতের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করা হয় বলেও বিএসএফ দাবি করেছে। 

এটা ঠিক যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটে থাকে। সেখানে চোরাচালান, অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের মতো ঘটনাও ঘটে। তবে এসব অপরাধীরা এতটা শক্তিশালী নয় যে, তারা দুই দেশের প্রশিক্ষিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সমন্বিত টহল জোরদার করে অপরাধীদের ধরে বিচারের মুখোমুখি করা যায়। অপরাধ দমনের নামে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। সীমান্তে হত্যা বন্ধের কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয় না। যেসব অস্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়, সেসব অস্ত্র সীমান্তরক্ষীরা ব্যবহার করতে পারবেন না বলেও একবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল; কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।

বিজিবি ও বিএসএফ স্থানীয়ভাবে যোগাযোগ করে একই সঙ্গে যার যার অংশে টহল জোরদারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বাস্তবে এমন সমন্বিত টহল হয়নি। চোরাচালান, অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের ঘটনায় দুই দেশের অপরাধীরাই জড়িত থাকেন। ফলে সীমান্তে ভারতীয় অংশে অপরাধীদের আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করলে, বিশেষ করে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উৎপাদনের কোনো কারখানা থাকলে তা ধ্বংস করা হলে অপরাধ এমনিতেই কমে যাবে। সীমান্তে নিযুক্ত বিএসএফ সদস্যরা দুই দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত নন। তাদের অনেকেই অবাঙালি এবং যুদ্ধের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অনেককে আবার কাশ্মীর সীমান্ত থেকে এনে বাংলাদেশ সীমান্তে ডিউটি দেয়া হয়। ফলে তারা শান্তিপূর্ণ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবহিত নন। তারা শুধু গুলি করতে জানেন। সীমান্তে প্রহরারত অবস্থায় বিএসএফ সদস্যরা মদ্যপ থাকেন কিনা সে সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবরও নেয়া হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো- সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার দুই দেশের বৈঠকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের সৈন্যদের দেয়া হয় না। ফলে এসব সিদ্ধান্ত থেকে যায় কথার কথা হয়ে। বাস্তবে সীমান্তে বেড়ে চলে লাশের মিছিল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //